৩রা জানুয়ারি ইরানের রেভিলিউশনারি গার্ড কর্পসের এলিট ইউনিট কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান ও দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে এক ড্রোন হামলায় প্রয়াত হন তিনি। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপি এক তুমুল উত্তেজনার পরিস্থিতি। বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিশ্ববাজারে নেমে আসে অস্থিতিশীলতা। হামলার জবাবে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সেনাদের ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান। ওই হামলায় কেউ নিহত না হলেও উভয় পক্ষই মধ্যে শান্তির প্রতি সমর্থন জানায়। চলমান উত্তেজনার অবসান ঘোষণা করে।
কিন্তু এই সংকটে জিতলো কারা? হারলো কারা? ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কী হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তরই দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
ইরান
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির মূল কারিগর হিসেবে পরিচিত ছিলেন কাসেম সুলেইমানি। অনেকে দাবি করেন, আয়াতুল্লাহ পরিবারের না হয়েও দেশটির পরবর্তী সুপ্রিম লিডার হওয়ার দাবিদার ছিলেন তিনি। বর্তমান সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে নিজের সন্তানতুল্য হিসেবে দেখতেন। তার মৃত্যু দেশটির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু একইসঙ্গে কিছু দিক দিয়ে সুলেইমানির হত্যাকাণ্ডে ইরান সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছে।
কয়েকদিন আগেই বিক্ষোভে জর্জরিত ছিল ইরান। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছিল তীব্র অসন্তোষ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স অনুসারে, বিক্ষোভ দমাতে ১৫০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সরকারি হিসাব প্রকাশ পায়নি। কিন্তু অনেকের ধারণা, প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এ ছাড়া, ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়। দেশটির উপর আরোপ করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সেসব নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে।
এমতাবস্থায় সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড জনগণের মনযোগ সরকারের প্রতি অসন্তোষ থেকে অন্যদিকে সরে গেছে। তার জানাজা ও দাফনে মানুষের ঢল দেখেই তার আভাস পাওয়া যায়। জীবিত থেকে সুলেইমানি যা পারেননি, খুন হয়ে তা পেরেছেন। ইরানের রাজনৈতিক অভিজাতদের এক করে দিয়েছেন। চরম সংকটের মধ্যে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তার হত্যার প্রতিশোধে সারাদেশ ঐক্যমতে পৌঁছেছে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা তারই ফসল। কিন্তু এখন ভবিষ্যতে আরো সহিংস পদক্ষেপ নিলে ফের গ্যাঁড়াকলে পড়তে পারে ইরান সরকার। অন্যদিকে, ইরান ও ইরাকের সামরিক শক্তিতে সুলেইমানির প্রভাব ছিল অদ্বিতীয়। শিয়াদের মধ্যেও তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। তার হত্যাকাণ্ডে সরকারের হালকা পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম দেয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বড় লাভবান পক্ষ হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। পূর্বে একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানি জেনারেলকে হাতের মুঠোয় পেলেও হত্যা করেনি। কিন্তু ট্রাম্প দাবি করেছেন, সুলেইমানি ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা করছিলেন, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এতে ইরানের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের ফের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে বহুগুণ। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইসরাইলের মতো মিত্রদের কাছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও ক্ষমতার একটি শক্তিশালী বার্তাও পাঠিয়েছে সুলেইমানি হত্যাকাণ্ড।
ইরানের পাল্টা হামলার পর ট্রাম্পও কিছুটা মিইয়ে গেছেন। প্রথম দিকে তীব্র হুমকি দিলেও পরে সহিংসতা না বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছেন। এমতাবস্থায় এই পথ অবলম্বনই তার প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থান। ফের সহিংসতা বেছে নিলে তার পরিণতি ভিন্ন হতে পারে। ইতিমধ্যে উচ্চকক্ষে তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের বিচারকার্য ঝুলে আছে। এ ছাড়া, সুলেইমানিকে হত্যার পেছনে এখনো সন্তুষ্টজনক বিস্তারিত তথ্য দেয়নি তার প্রশাসন। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাপক এই জয়, বিধ্বংসী পরাজয়ে রূপ নিতে পারে।
ইরাক ও শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের জন্য বড় আঘাত। কিন্তু ভিন্ন দিক বিবেচনায়, এটা তাদের জন্য কিছুটা লাভজনকও। বিগত কয়েক মাস ধরে ইরাকে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। মোতায়েন করেছে শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী। হতাহত হয়েছেন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী। দেশটিতে ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে। সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড জনগণের মনে শিয়া মিলিশিয়াদের প্রতি ফের সহানুভ’তি জাগিয়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে, সরকার-বিরোধী বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ইরাক সরকারের জন্যও এই ঘটনা লাভজনকই ধরা যায়।
ইসরাইল
ইরান ও ইসরাইলের শত্রুতা বহুদিনের। ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরান তাদের ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। একইসঙ্গে ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ তাদের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত।
এদিকে, সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড এটাও প্রমাণ করে যে, আমেরিকা ইরানকে দমিয়ে রাখতে ইচ্ছুক। ইসরাইল এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে।
সৌদি ও আমিরাত
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের জন্য স্বস্তির ঘটনা। গত বছর ইরান নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালীতে উভয় দেশের বাণিজ্যিক নৌযানই হামলার শিকার হয়। হামলা হয় সৌদির প্রধান তেল স্থাপনায়ও। ইরান অবশ্য এসব হামলার দায় অস্বীকার করেছে। কিন্তু সৌদির দাবি ইরান এসব হামলার সঙ্গে জড়িত। হামলার পরপর ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সৌদি আরব কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
ইউরোপ
ইরানের সঙ্গে ট্রাম্প চুক্তিভঙ্গের পর থেকে সেটি রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউরোপীয় শক্তিগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন সফল হয়ে ওঠেনি তারা। সুলেইমানি হত্যাকাণ্ড তাদের জন্য দুঃসংবাদই বটে। ইরান জানিয়েছে, তারা এই হত্যাকাণ্ডের কঠোর জবাব দেবে। পারমাণবিক চুক্তির শর্ত মানবে না।
এদিকে, বৃটেন জানিয়েছে তারা সুলেইমানির বিরুদ্ধে মার্কি অভিযান সম্পর্কে আগ থেকে জানতো না। এতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একইদিকে আইএস বিরোধী যুদ্ধের জন্য ইরাকে নিয়োজিত রয়েছে ন্যাটো সদস্যগুলোর সেনারা। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনার মাঝে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে একাধিক দেশ। এতা আইএস নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পেতে পারে। (বিবিসি অবলম্বনে)