দীর্ঘ ২৮ বছর পর বড় কোনো শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা। এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা উৎসব করেছে মেসি বাহিনী। ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে এটি লিওনেল মেসিরও প্রথম শিরোপা। কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে তিন তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে আলো কাড়েন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। আর ফাইনালের টিকিট কেটে অধিনায়ক মেসির সঙ্গে নিবীড় আলিঙ্গনের ছবি এবং মার্টিনেজের আবেগঘন মন্তব্য মন কাড়ে ফুটবলপ্রেমীদের। মেসির প্রতি তার আবেগী মনোভাবটা প্রকাশ পেলো আরো একবার। মার্টিনেজ বললেন, এবার বিশ্বকাপ উপহার দিতে চান মেসিকে। সদ্য কোপা আমেরিকা শিরোপাজয়ী এমিলিয়ানো মার্টিনেজের সাক্ষাৎকার নিয়েছে আর্জেন্টাইন ক্রীড়া দৈনিক ওলে।
মেসিকে নিয়ে মুগ্ধতা ঝরেছে মার্টিনেজের কণ্ঠে।
লিওনেল মেসির কোন বিষয়গুলো দাগ কেটেছে তার মনে? এমন প্রশ্নে মার্টিনেজ বলেন, উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি আমাকে বলেছিলেনÑ ‘ওদের ক্রসগুলো সামলে নিয়ো, ওরা ক্রসে অনেক আগ্রাসী।’ অধিনায়ক হিসেবে অনেক নির্দেশনা দেন তিনি, আমাদের সবাইকে সাহায্য করেন। সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনি পেনাল্টিতে গোল করার পর চাইলেই আবার ফিরে সোজা মাঝবৃত্তের দিকে চলে আসতে পারতেন, কিন্তু সেটা না করে তিনি আমার দিকে গেলেন, বললেন, ‘দেখো, তুমি ঠিকই একটা শট ঠেকিয়ে দেবে!’ পরের শটটাই ঠেকিয়ে দিলাম আমি! তার প্রভাব এমনই। এটাকে শব্দে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এতটুকু বলি, তিনি অসাধারণ একজন অধিনায়ক, দুনিয়ার সব দলই তাকে অধিনায়ক হিসেবে পেতে চাইবে।
ইনস্টাগ্রামে গোলরক্ষক মার্টিনেজকে নিয়ে আবেগপ্রবণ পোস্ট দিয়েছিলেন মেসি। এ নিয়ে মার্টিনেজ বলেন, ‘ওটা দেখে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এই শব্দগুলো, এই ছবিগুলো এমন যেগুলো আপনি সারা জীবন নিজের কাছে রাখতে চাইবেন। ওর সঙ্গে আমার আলিঙ্গনের ছবি, এমন ছবি সারা জীবন রেখে দেয়ার মতো। শুধু ইনস্টাগ্রাম পোস্টই নয়, সেমিফাইনালেও তিনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এরপর ইনস্টাগ্রামে ছবি। এসব কিছু ফাইনালে আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে, আরও ভালো করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমাকে শক্তি জুগিয়েছে।
তিনি যে একটা ছবি দিয়ে ক্যাপশনে লিখলেন, ‘ও একটা ফেনোমেনন’, এরপর ফাইনালে কীভাবে আমি ভালো না খেলি! তার জন্য আমি জীবন দিতে পারি, মরতে পারি। চার-পাঁচ মাস আগেও বলেছিলাম যে আমার আগে তিনিই কোপা আমেরিকা জিতলে আমি বেশি খুশি হবো (তখনো আর্জেন্টিনা দলে ডাক পাননি মার্টিনেজ)। এটা মন থেকেই বলেছি, প্রত্যেক আর্জেন্টাইনই এটা বলবে। আমার মনে হয়, ব্রাজিলিয়ানরাও আর্জেন্টিনাকে কোপা জিততে দেখতে চেয়েছিল শুধু মেসির কারণে। আর সেখানে একজন আর্জেন্টাইন চাইবে না মেসি এটা জিতুক? শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। এখন আমার স্বপ্ন, আমরা তাকে যেন বিশ্বকাপটাও উপহার দিতে পারি।
ফাইনালে ডি মারিয়ার একমাত্র গোলের আগে ডিফেন্স চেরা লম্বা পাসটি দিয়েছিলেন রদ্রিগো ডি পল। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের এ মিডফিল্ডার বলেছিলেন অনুশীলনে মেসিকে কখনো হারতে না দেখাটা তাকে চমকে দিয়েছে। মেসির কোন দিকটি মার্টিনেজকে চমকে দিয়েছে? মার্টিনেজ বলেন, জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকার সময়ে আমরা ট্রুকো (কার্ডের খেলা) খেলতাম। মার্চেসিন, মুসো আর আমি এক দলে, অন্য দিকে মেসি, পারেদেস আর ডি পল। ২০-৩০ রাতে আমরা ট্রুকো খেলেছি। তিনি আর দশজন মানুষের মতোই! অসাধারণ একজন মানুষ, যিনি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিততে খুব করে চাইতেন, সম্ভবত জাতীয় দলে অন্য যে–কারও চেয়ে বেশি করে চেয়েছেন। তার এই চাওয়াটাই আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের গ্রুপটাতে নতুন অনেক খেলোয়াড় এসেছে, সবার মধ্যে এই মানুষটার জেতার বাসনা ছড়িয়ে গেছে। এরপর আমরা কিছু জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে না পড়ি কীভাবে?
লিওনেল মেসির সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন? মার্টিনেজ বলেন, আপনারাই লিখেছেন, আমি এমন একজন আর্জেন্টাইন, যে কিনা তার স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছে। সেটার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই থামাইনি। আমি জানি না লিও আর কতগুলো কোপা আমেরিকা বা বিশ্বকাপ খেলতে পারবে, অন্তত একটা কোপা আমেরিকা তার পাশে খেলতে পারা…কোপা আমেরিকায় যখন আমার অভিষেক হয়েছে, আমি তখনই বলেছিলাম, আমার স্বপ্ন ছোঁয়া হয়ে গেছে। এরপর আমরা শিরোপাও জিতলাম, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের সঙ্গে যেকেউই খেলতে চাইবে, আর একই দলে থেকে তাকে খেলতে দেখা আমাকে গোলপোস্টে আরও ভরসা দিয়েছে, খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে আরও ভালো বানিয়েছে। আপনারাই লিখেছেন, তিনি অন্য খেলোয়াড়দের ভালো খেলতে সাহায্য করেন। সেটা সাধারণত মাঠের অন্য ৯ জনকে নিয়ে বলা হয়, কিন্তু তিনি আমাকেও ভালো খেলতে সাহায্য করেছেন, অথচ আমি একজন গোলকিপার! আমার মনে হয়, যদি তার সঙ্গে একই লীগে প্রতি ম্যাচ খেলতে পারতাম! গোলকিপার হিসেবে আরও ভালো হয়ে উঠতাম।
অ্যাস্টন ভিলায় দারুণ মৌসুম শেষে জাতীয় দলের সঙ্গে ৪৫ দিন ছিলাম। অ্যাস্টন ভিলায়ও আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছি আমি, কিন্তু জাতীয় দলে আরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উন্নতি করেছি। ছোটবেলায় আপনি ‘ড্রাগন বল জি’ (জাপানিজ অ্যানিমেট টিভি সিরিজ) দেখেছেন? আমি সেখানকার ভেগেটা ছিলাম, মেসির সঙ্গে খেলার সময়ে আমি সেখান থেকে সুপার সাইয়ান হয়ে গেলাম!
প্যারিস সেইন্ট জার্মেই পিএসজি) ক্লাবের আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার লিয়ান্দ্রো পারেদেস বলেছেন মেসি মাঠে যা করেন, দেখে অবিশ্বাস্য লাগে। মার্টিনেজের চোখে মেসির এমন অবিশ্বাস্য কিছু আছে? মার্টিনেজের উত্তর, ঠিক কোনো নির্দিষ্ট মুভ দিয়ে উত্তর দেয়া যাবে না। ফ্রি-কিকের কথা ধরুন, মেসির ফ্রি-কিক নেয়া মানেই গোল হওয়ার পথে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া। একটা ডেড বল এটা, এটাতে তিনি ক্রস ঠিকঠাক লাগাতে পারলেই গোল। তিনি যখন বল পায়ে পান, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে তিনি সহজে বল হারাবেন না। ধরুন আমরা ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ১-০ গোলে এগিয়ে আছি, মেসি বলটা নিয়ে প্রতিপক্ষ কর্নারের দিকে চলে যাবেন। তখনো ম্যাচের পাঁচ মিনিট বাকি থাকলেও আপনি ধরে নিতে পারেন আমরা ম্যাচটা জিতে গেছি। এই ব্যাপারগুলোই আপনাকে অনেক নির্ভরতা দেবে। অ্যাস্টন ভিলায় আমরা কিছু ম্যাচ হেরেছি ৯১-৯২তম মিনিটে গোল খেয়ে। কিন্তু এখানে প্যারাগুয়ে কিংবা উরুগুয়ের মতো দলের বিপক্ষে ৮৯তম মিনিটেও বলটাকে আমরা ওদের কর্নারের দিকে নিয়ে যাওয়া মানে ধরে নেয়া যায় আমরা ১-০ গোলে জিতছি। এই ব্যাপারগুলো স্বস্তি দেয়। এই যে ছোট ছোট ব্যাপার, এগুলো আমাদের সবাইকে নির্ভার হয়ে আরও ভালো খেলতে সাহায্য করেছে।