বাস ও ট্রাকের পর এবার সারা দেশে বন্ধ হলো লঞ্চ। এখন চলছে শুধু ট্রেন ও সীমিত আকারে বিআরটিসির বাস। ডিজেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহার বা ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে টানা দ্বিতীয় দিনেও অব্যাহত ছিল সড়ক পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘট।
একই দাবিতে শনিবার বিকাল থেকে আকস্মিকভাবে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেন মালিকরা। এতে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গণপরিবহণ না পেয়ে বিকল্প যানবাহনে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া।
যাত্রীদের জিম্মি করে এমন ধর্মঘট এবং সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থা না নেওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে, দুর্ভোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তা দেখার যেন কেউ নেই। মানুষ যাবে কোথায়-এমন প্রশ্ন ছিল মুখে মুখে। শুক্রবার সকাল থেকে বাস ও ট্রাক ধর্মঘট শুরু হয়।
এছাড়া পরিবহণ ধর্মঘটে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পণ্য সরবরাহ কম হওয়ায় বাজারে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে।
আজ রোববার অফিস-আদালত খোলার দিন পরিবহণ ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে মানুষের ভোগান্তির তীব্রতা আরও বাড়বে-এমন আশঙ্কা চাকরিজীবীদের। এদিকে বাস-লঞ্চ বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে ট্রেনের ওপর। কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে উপচে পড়া যাত্রী উঠতে দেখা যায়।
বাসের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে আজ বৈঠকে বসছেন বাস মালিকরা। জানা গেছে, জ্বালানি তেলের বাড়তি দামসহ ১৯টি খাতের ব্যয় ধরেই ভাড়া নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া চলছে।
প্রতিটি ধাপেই বাড়তি দর যুক্ত করে নতুন ভাড়া নির্ধারণের দাবি করেছেন মালিকরা। ২০১৯ সালে দূরপাল্লার ৫২ আসনের বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৭ পয়সা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত বাসে ২ টাকা ২১ পয়সা প্রস্তাব করেছিল বিআরটিএ।
ওই হারের চেয়ে আরও বেশি ভাড়া নির্ধারণের দাবি করছেন তারা। বর্তমানে দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৪২ পয়সা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসে ১ টাকা ৭০ পয়সা ভাড়া নির্ধারিত আছে।
অপরদিকে পণ্যবাহী ট্রাক ধর্মঘট নিরসন নিয়ে শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পরিবহণ নেতাদের একাংশের বৈঠক হলেও তা সফল হয়নি। এ অবস্থায় তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহারসহ কয়েকটি দাবিতে পণ্যবাহী ট্রাক ধর্মঘট চালিয়ে যেতে অনড় অবস্থায় রয়েছেন মালিক-শ্রমিক নেতারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, শুক্রবারের চেয়ে শনিবার রাজধানীর সড়কে মানুষের উপস্থিতি বেশি ছিল। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ড ও মোড়গুলোতে শত শত মানুষকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা খোলা থাকায় কর্মজীবীদের ভোগান্তিও বেড়েছে কয়েকগুণ। এর সুযোগ নিয়েছে রিকশা ও অটোরিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহন। একই চিত্র দেখা গেছে দূরপাল্লার রুটেও।
বাস বন্ধ থাকায় প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মিনি ট্রাকে গাদাগাদি করে ভেঙে ভেঙে যেতে দেখা গেছে। খুলনার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া মিজানুর রহমান বলেন, পারিবারিক জরুরি কাজে খুলনা যেতে হচ্ছে।
সিএনজি অটোরিকশায় গুলিস্তান থেকে মাওয়া যেতে ভাড়া হাঁকছে ৩০০ টাকা। অন্য সময়ে বাসে একশ টাকায় এ পথ যেতাম। তিনি বলেন, লঞ্চে পদ্মা নদী পার হয়ে আবার বিকল্প যানবাহনে খুলনা যেতে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এভাবে এত দূরের পথে যাওয়া কি যায়? আমাদের ভোগান্তি দেখার কী কেউ নেই।
দূরপাল্লার মতো রাজধানীবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বনানীতে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ শরিফুল ইসলাম বলেন, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে বনানী পর্যন্ত যেতে সিএনজি অটোরিকশাচালক নূর ইসলাম ভাড়া চেয়েছেন ৪৫০ টাকা।
৪০০ টাকার নিচে যাবেন না। পরে বাধ্য হয়ে ৪০০ টাকায় যেতে হয়েছে। এ কর্মকর্তা বলেন, রোববার সরকারি অফিস-আদালতও খুলবে। ওইদিন বাস না চললে মানুষের ভিড়ে রিকশাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। হেঁটে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।
পরিবহণ খাতের অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বাসের ভাড়া আমরা নির্ধারণ করে থাকি। ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় না।
তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহারের দাবিতে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার বিষয়টি আমাদের আওতাধীন নয়। যৌক্তিক কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তেলের দাম কমানোর এখতিয়ার ওই মন্ত্রণালয়ের। তিনি বলেন, বাস ভাড়ার বিষয়টি আমরা দেখছি। সবার জন্য ভালো হয় এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিদ্যমান ভাড়ার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অতিরিক্ত বাড়াতে সরকার রাজি হলে তারা আজই ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেবেন।
তারা বলেন, ২০১৯ সালেই ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ওই সময়ে সড়ক পরিবহণ আইন নিয়ে আন্দোলনের কারণে ওই সময়ে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। মালিকরাও চুপ ছিলেন। গত দুই বছরে যন্ত্রাংশ ও তেলের দাম বেড়েছে।
দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভাড়া না বাড়ালে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। আর আমাদের দাবি মেনে নিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে।
জানতে চাইলে এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ভাড়া নির্ধারণ করবে। ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা হলেই মালিকরা বাস চালাবেন।
এদিকে পণ্য পরিবহণ ধর্মঘট নিয়ে শনিবার ধানমন্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে তার বাড়িতে বৈঠক করেন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের একাংশ। এতে পরিবহণ নেতারা জ্বালানি তেলের দাম ও দুটি সেতুর বাড়তি টোল প্রত্যাহারের দাবি জানান।
বৈঠকে দাবি আদায় না হওয়ায় পণ্য পরিবহণ নেতারা তাদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি তালুকদার মো. মনির বলেন, আমরা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার, চাঁদা আদায় বন্ধ, ব্রিজের বাড়তি টোল আদায় বন্ধসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি।
এগুলো মানা হলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ওই বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব। শনিবার রাতে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেহেতু আমাদের আর কোনো কিছু জানাননি, তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাড়া বাড়ানো হলে বাস মালিকরা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাকের ধর্মঘট চলবে।
বরিশাল নদীবন্দরে হাজারো যাত্রী : বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশাল থেকে সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার যাত্রী। শনিবার সন্ধ্যার পর তারা বরিশাল নদীবন্দরে এসে ফিরে গেছেন।
সন্ধ্যায় বরিশাল নদীবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, ঘাটে থাকা দূরপাল্লার অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী তিনটি লঞ্চ ঘাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, বাকি তিনটি লঞ্চ ঘাটেই রয়েছে। বিকাল থেকে যাত্রীরা ঘাটে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। গতকাল বরিশাল থেকে ঢাকায় ৬টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা ছাড়েনি।
সোয়েব আহম্মেদ নামে এক যাত্রী জানান, ভাড়া বৃদ্ধির জন্য যাত্রীদের জিম্মি করে হঠাৎ লঞ্চ বন্ধ করা বিবেকহীন কাজ। এ সিদ্ধান্ত বিকাল ৩টায় না নিয়ে আরও আগে নিতে পারত। তা হলে আমরা ঘাটে এসে এই বিড়ম্বনায় পরতাম না।
রুমি নামের এক যাত্রী বলেন, লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রেখে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পরত। তা হলে হাজার হাজার যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।