রাজধানীর রামপুরায় সোমবার রাতে অনাবিল পরিবহণের বাসচাপায় শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার রাজধানীর রামপুরা, মোহাম্মদপুর, বনানী, নীলক্ষেত, ধানমন্ডি, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করে। মতিঝিলে বাসে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। এদিকে মাইনুদ্দিনকে যে বাসটি চাপা দিয়েছে তার হেলপার চাঁন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া চাপা দেওয়ার ঘটনায় রামপুরা থানায় দুটি মামলা হয়েছে। মাইনুদ্দিনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার মা-বাবা। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয় স্বজনদের কাছে। এই ঘটনার বিচার, হাফ ভাড়া নির্ধারণসহ নয় দফা দাবিতে আজ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ঢাকা ন্যাশনাল কলেজের একদল শিক্ষার্থী সকাল পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজে এসে অবস্থান নেয়। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজ ও বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা।
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, সকাল ১০টার পর শিক্ষার্থীরা ডিআইডি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পুলিশের হস্তক্ষেপে বিকাল ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে চলে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বেলা ১১টার পর মোহাম্মদপুরের আল্লাহ করিম মসজিদের সামনের মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে একদল শিক্ষার্থী। মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) দুলাল খান জানান, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাত্রদেরবুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। বেলা ১২টার দিকে ওই এলাকার যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান জানান, দুপুর ১২টার দিকে ধানমন্ডির-২৭ নম্বরের সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুর ২টার দিকে তারা অবরোধ তুলে নেওয়া হলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা সরকারকে দ্রুত দাবি মেনে নেওয়ার আলটিমেটাম দেয়। তা না হলে বুধবার (আজ) ফের সড়কে নামার ঘোষণা দেয় তারা।
শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিনকে হত্যার প্রতিবাদে এদিন মতিঝিলে বিক্ষোভ মিছিল বের করে আই?ডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। মিছিল শাপলা চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন ছাত্র দুটি বাস ভাঙচুর করে।
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার রাতে বাসচাপায় শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয় নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। মাইনুদ্দিনের মা রাশিদা বেগম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। তিনি আরও জানান, মাইনুদ্দিন নিহত হওয়ার পর উত্তেজিত জনতা কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এ মামলায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। রামপুরায় বাসচাপায় নিহত মাইনুদ্দিনের বাবা আব্দুর রহমান এবং মা রাশিদা বেগম চা বিক্রি করে সংসার চালান। ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা ছিল তাদের। ঘাতক বাস কেবল তাদের ছেলেকেই হত্যা করেনি। হত্যা করেছে তাদের স্বপ্ন।
সরেজমিন পূর্ব রামপুরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিহত মাইনুদ্দিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে রাশেদা বেগম পথে বসে আছেন। সারা রাত এক জায়গাতেই বসেছিলেন। পূর্ব রামপুরায় নিজের ভাড়া বাড়ির ঘরে তালা ঝুলিয়েছেন। ছেলে ফেরার আগে নাকি ঘর খুলবেন না। স্থানীয়রা জানান, মাইনুদ্দিনদের পাঁচ সদস্যের পরিবারটি চলে মহল্লার ছোট্ট একটি চায়ের দোকানের আয়ে।
মাইনুদ্দিনের বাবা আবদুর রহমান এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, তার ছেলে নেই। তিনি বারবার হাত বাড়িয়ে ডাকছেন ছেলেকে। গত রাত থেকে পানিও খাননি। কেউ বোঝাতে গেলেই বলছেন, ‘হাসপাতাল থেকে আমার ‘মাইনু’ আগে ফিরে আসুক। ওর হাতে পানি খাব।’
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডেকেল কলেজ হাসপাতাল ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় এসএসসির ফলপ্রত্যাশী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের লাশের। লাশের ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাত নাঈম। পরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে কেবল ঢাকা মহানগরে শর্তসাপেক্ষে ‘হাফ’ ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে শিক্ষার্থীরা। তারা কোনো শর্ত ছাড়াই সারা দেশে বাসে হাফ ভাড়া চান। মঙ্গলবার বনানীতে বিআরটিএ ভবনে গিয়ে সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে নিজেদের দাবিনামা তুলে ধরেন শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল। পরে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা। প্রতিনিধি দলের একজন ও স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী এনজামুল হক রামিম বলেন, নয় দফা দাবিতে বুধবার (আজ) সারা দেশে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আসাদুজ্জামান জানান, বেলা ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিআরটিএ কার্যলয় অবরোধ করে। তারা কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়ে বিক্ষোভ করে। বেলা ৪টার দিকে তারা চলে যায়।
জানা যায়, মঙ্গলবার ভোরে বাসের হেলপার চাঁন মিয়াকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রথমে মাইনুদ্দিনকে ধাক্কা দেয় বাসটি। ধাক্কার পর ছিটকে পড়ে বাসের নিচেই চাপা পড়ে মারা যান মাইনুদ্দিন।
উল্লেখ্য, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বাসের ভাড়া ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে ১৮ নভেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করেন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই গত বুধবার সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হয়। আর সোমবার রাতে রামপুরায় অনাবিল পরিবহণের একটি বাসের চাপায় একরামুন্নেসা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া মাইনুদ্দিনের নির্মম মৃত্যু হয়। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৯ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।