রিকশার প্যাডেল ঘুরানোর জন্য দরকার শক্তি। সেই সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে অনেক আগেই। তবুও প্রতিদিন রিকশার প্যাডেল ঘোরানোর যুদ্ধে চলে ৯৮ বছর বয়সী রণজিত ঘোষের জীবিকার চাকা।
জীবনের এ বয়সে এসে আর কোনো উপায়ও নেই তার। রিকশা চালিয়ে উপার্জিত সীমিত অর্থে জোগাড় করেন তিনবেলার আহার। কোনো রকমে খাবারের ব্যবস্থা হলেও নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই।
তাই দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে ফুটপাতে রাত্রিযাপন করেন রণজিত। এভাবেই কাটছে তার দিন। সম্প্রতি তার জীবন সংগ্রামের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়িছে।
রণজিত ঘোষের আদি বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জামালপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।
এক সময় হোটেলে বাবুর্চির কাজ করলেও বর্তমানে রিকশা চালান। স্বজন বলতে তার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে যশোর শহরের চৌরাস্তার ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (এনএলআই টাওয়ার) ভবনের নিচে ফুটপাতে ঘুমান।
যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বজন সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার দাস বলেন, শতবর্ষী রণজিত কুমারের জীবন সংগ্রাম যেকোনো হৃদয়বান মানুষকে স্পর্শ করবে। স্বজনরা মানুষটির সংগ্রামের গল্প আমাকেও অশ্রুসিক্ত করেছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জীবনের গল্প উঠে এসেছে। তার সহায়তায় বিবেকবান মানুষের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার আক্ষেপ তুলে ধরে রণজিত ঘোষ বলেন, ‘কতো নিতার (নেতা) কাছে গিলাম, সবাই ফিরোয়ে দেচে। লাগবে না আইডি কাড। কী হবে এখন আর আইডি কাড দিয়ে!’
তিনি বলেন, ‘চার বছর বয়সে মা মরে গেছে। সৎমার গালাগাল শুনিচি ম্যালা। দশ বছর বয়সে এ যশোরে আইচি। বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চির কাজ করিছি। সৎমারে আড়াল করে বাবা যশোরে এসে টুকটাক খোঁজ খবর নিতো। দেখাশুনা করে আমারে বিয়ে দিয়ার কয়দিন পরেই বাবা মরে গ্যালো। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার এক বছর পরে আমার ৩ ছেলে মরে গ্যাচে ডায়রিয়ায়। ওদের বয়স তখন ৫ বছরের কম। একটা মেয়ে ছিল। এখন বেঁচে আছে কিনা জানিনে। মেয়েরে বিয়ে দিছিলাম। বিয়ের পরে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলে হওয়ার দেড় মাস পরে বাচ্চাটকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসলো মেয়ে। খুব কষ্টে মেয়ের নামে একটা বাড়িও কিনিছিলাম আকবরের মোড়ে (যশোর শহরের একটি জায়গা)। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গ্যাছে তার খোঁজ আজও মেলেনি।’
রণজিত বলেন, ১১ বছর আগে আমার স্ত্রী মরে গেছে। মেয়ের রেখে যাওয়া দেড় মাসের ছেলেকে বড় করলাম, বিয়ে দিলাম। এখন আমার দুনিয়ায় এ রিকশা ছাড়া আর আপন বলতে কেউ নেই!’
এ বৃদ্ধ আরও বলেন, রিকশা চালায়ে কোনো কোনো দিন ৬০ টাকা, ৮০ টাকা, ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা আয় হয়। যা আয় করি তাই দিয়ে হোটেলে কোনো রকম দুবেলা দুমুঠো খেয়ে দিন পার করছি। বাড়ি ঘর হারানোর পরে এক হাজার টাকার ভাড়া বাসায় একাই থাকতাম। রোজগার ভালো হয় না; তাই ভাড়া করা বাসা ছেড়ে এখন ফুটপাতে থাকি।