স্কুলের মূল্যায়ন নিয়ে বড় উদ্বেগ অভিভাবকদের

আগামী বছর প্রবর্তিত হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। দেশের ইতিহাসে এটা চতুর্থ। এর আগে তিনটি শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হলেও এবারই প্রথম খোলনলচে বদলানো হচ্ছে।

পাঠ্যবই, পাঠদান, তদারকি আর মূল্যায়নসহ সবকিছুতেই আসছে আমূল পরিবর্তন। এই শিক্ষাক্রম চালু হলে থাকবে না সৃজনশীল পদ্ধতি।

তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তারও শেষ নেই অভিভাবকদের। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষকের কাছে মূল্যায়ন রাখায় শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।

শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ানোর চাপ এবং কোচিং বাণিজ্য আরও রমরমা হবে কি না-এমন প্রশ্নও বড় হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে নোটগাইড ব্যবসাও জমজমাট হবে। এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট অনেকের।

প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। উপযুক্ত পাঠ্যবই তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নতুন ধারার পাঠদান এবং সঠিক মূল্যায়ন হবে অন্যতম ইস্যু। এছাড়া বিদ্যমান সৃজনশীল ও এমসিকিউ পদ্ধতির স্থলে লিখিত পরীক্ষার নতুন রূপ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের কাছে পরিচিত করানোও কম চ্যালেঞ্জ নয় বলে মনে করেন তারা।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর থেকে একটি শিক্ষাক্রম চলে আসছিল। পরে ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে আরও দুটি শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়। এর মাঝখানে মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশে যুক্ত হয় আরও দুটি দিক। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে এমসিকিউ ও ২০০৮ সালে সৃজনশীল চালু এবং ২০০১ সালে নম্বরের পরিবর্তে চালু করা হয় গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল তৈরি। এসব পরিবর্তন করা হলেও ছাত্রছাত্রীদের মূলত মুখস্থ করেই উত্তর লিখতে হতো। কিন্তু এবার মুখস্থের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর হাতেকলমে শেখার অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে হবে। শিক্ষার্থী তার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে শিখবে এবং সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উত্তর লিখবে। এ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পাঠদানে আসছে নতুন ধারা। এটি বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘খসড়ায় যতটা দেখেছি, নতুন শিক্ষাক্রমে ইতিবাচক অনেক দিক আছে। আবার তা বাস্তবায়নেও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে স্কুলে মূল্যায়ন অন্যতম। আমরা যখন শিক্ষাক্রমের ওপর তৃণমূলে অভিভাবকদের মতামতের জন্য যাই, তখন তারা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অভিভাবকরা বলেছেন, এর আগে ‘এসবিএ’ (স্কুল বেজড অ্যাসেসমেন্ট) চালু হয়েছিল। সেটির কারণে একশ্রেণির শিক্ষক প্রাইভেট-টিউশনে জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি নোট-গাইড ব্যবসাও রমরমা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘ভালো কিছু থেকে সুফল পেতে হলে তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ সংসদে এটি পাশ করা একটি দলিল। আবার এ দলিলে নেই-এমন জিনিসও শিক্ষাব্যবস্থায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা এর বড় দৃষ্টান্ত।’

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘ইতোমধ্যে দুই মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। জনগণের মধ্যে এমনিতেই ধারণা আছে যে, তাদের বাচ্চাদের ‘গিনিপিগ’ করা হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, ‘যদি আন্তঃমন্ত্রণালয় একই মতে কাজ করে একই ধারার শিক্ষাক্রম চালু করতে না পারে, তাহলে যেমন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে না, তেমনই জনগণের মধ্যেও অসন্তোষ থাকবে।’

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে, ‘এক্সপেরিয়েন্সিয়াল’ বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম আসছে। ছাত্রছাত্রীরা পুথিগত বিদ্যার খোলস থেকে বেরিয়ে হাতেকলমে প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখবে। বিদ্যমান শিক্ষাক্রম অনেকটাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক। এর ফলে শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের চেয়ে পরীক্ষায় ভালো করার দিকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।’

গত সোমবার শিক্ষাক্রমের রূপরেখা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। এরপর থেকেই এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সচেতন অভিভাবকরা তাদের মতামত পেশ করছেন। আমিনুল ইসলাম সোহাগ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র ফেসবুকে লেখেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন! ছাত্রছাত্রীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে শিক্ষকরা। এক প্র্যাকটিক্যালে যে খেলা দেখান তারা…শিক্ষকের সুদৃষ্টি…ধরে রাখতে হলে সব বিষয়েই প্রাইভেট/কোচিং বাধ্যতামূলক হবে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘শিক্ষকবৃন্দ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না…এই নিয়ম চালু হওয়া উচিত।’

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে শুধু কোচিং বা প্রাইভেটই নয়, নোট-গাইড ব্যবসারও সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে স্কুলে ছেড়ে দেওয়া মূল্যায়ন নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কেননা এর আগে ‘এসবিএ’ চালুর পর শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘স্যারের বাসায় এসো’। ভালো নম্বর পেতে শিক্ষকের কাছে কোচিং-প্রাইভেট পড়তে হয়েছিল।’ তবে তিনি মনে করেন, ‘প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় শিক্ষকের হাতে সর্বময় ক্ষমতা চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি শিক্ষকের ‘পড়ানো’র চিরাচরিত ভূমিকায় পরিবর্তন আসবে। শিক্ষক থাকবেন কেবল ‘ফ্যাসিলিটেটর’ (সমন্বয়কারীর ভূমিকায়) হিসাবে। শিক্ষকের পাশাপাশি শিক্ষার্থী নিজেকে মূল্যায়ন করবে। এছাড়া তার সহপাঠী এবং স্কুলের বাইরে সমাজে যার কাছ শিখবে তিনি বা তারা মূল্যায়ন করবেন। মূল্যায়নে নম্বরের পরিবর্তে ‘মন্তব্য’ দেওয়া হবে। ‘ভালো’, ‘খুব ভালো’, ‘আরও শেখা প্রয়োজন’ ধরনের মন্তব্য যখন দেওয়া হবে, তখন শিক্ষার্থীর আর জিম্মি হওয়ার সুযোগ থাকবে না।’

অধ্যাপক আহসান আরও বলেন, উল্লিখিত ব্যবস্থায় পাঠ্যবই হবে অনেকটা নির্দেশনাকেন্দ্রিক। আর পাঠ হবে ‘কার্যক্রম’ভিত্তিক। ফলে শিক্ষকের যেমন পড়ানো ও মুখস্থ করানোর কিছু থাকবে না, তেমনই নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের পাঠ বা উত্তর তৈরির সুযোগ থাকবে না। ফলে কোচিং আর গাইডের ধারেকাছে শিক্ষার্থীকে যেতে হবে না। পাবলিক পরীক্ষার বাইরে যে পরীক্ষাগুলো থাকবে স্কুল-মাদ্রাসায়, সেখানে কাগজ-কলমের দরকার খুব কম হবে। মুখস্থ কিছু লেখার পরিবর্তে সৃজনশীল সমস্যা সমাধানের কাজ দেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মনিটরিংয়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি গ্রুপকেই তৈরি করার প্রয়োজন আছে। যে কারণে গোটা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ৫টি বছর নেওয়া হচ্ছে। আগামী বছর প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পুরোপুরি চালু করা হবে। প্রাথমিকে যাচ্ছে পরীক্ষামূলক ভার্সন। তিনি বলেন, শিক্ষকদের প্রস্তুতের জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণের দরকার আছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রশিক্ষণে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। অনলাইনে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের জন্য পোর্টালে ও অ্যাপে কনটেন্ট (পাঠ) রাখা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে পাবলিক পরীক্ষা নেই। দশম শ্রেণিতে এসএসসি আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে এইচএসসি পরীক্ষা দুটি হবে। আর ফল হবে দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে। এই অবস্থায় পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে হবে। এই প্রশ্নের জবাবে ড. আহসান বলেন, বিদ্যমান সৃজনশীল প্রশ্ন থাকবে না। শিক্ষাক্রম যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক হবে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রশ্ন হবে। তাই এখনকার মতো বেশি বেশি উদ্দীপক পড়ার জন্য একাধিক গাইড কেনার প্রয়োজন হবে না। পরীক্ষায় এখনকার মতো এমসিকিউ থাকবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা আরও পরে এটি নির্ধারণ করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *