নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস, কাল থেকে কার্যকর

এই বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি এবং কর–বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। নতুন বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এবারের বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।

মঞ্জুরি দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব

নতুন অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা ৬৬৪টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন ১৩ জন সংসদ সদস্য। সব প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির অনুপস্থিতিতে তাঁদের মঞ্জুরি দাবি তোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো দেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, রওশন আরা মান্নান, পীর ফজলুর রহমান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, রুস্তম আলী ফরাজী ও পনির উদ্দিন আহমেদ, বিএনপির হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা ও মোশাররফ হোসেন, গণফোরামের মোকাব্বির খান ও স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু।

এদিকে বাজেটের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের যে সংযুক্ত দায় রয়েছে, সেগুলো মিলিয়ে মোট ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫১ কোটি ৮১ লাখ ৯৭ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয় আজ। নির্দিষ্টকরণ বিল পাসের সময় সংসদে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান অর্থমন্ত্রীকে। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচন কমিশন দন্তহীন বাঘ

বাজেটের মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনার সময় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়েই বেশি কথা বলেছেন।

যেমন জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এখন নির্বাচন করে না, নির্বাচন করে প্রশাসন। তিনি বলেন, সাবেক সিইসি নূরুল হুদা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে। তাহলে তিনি কেন ইভিএমে নির্বাচন করলেন?

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, দেশে যখন নির্বাচন থাকে, তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। নির্বাচন না থাকলে এবং দিনের ভোট যখন রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে? তিনি বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এ ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়, পুলিশ প্রশাসনও ডাকাতি করে।

রুমিন ফারহানা আরও বলেন, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীনকে পুরস্কার হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। অবসরে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে তিনি ইউরোপ সফরে যান।

জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ইভিএমের কোনো দোষ নেই। যারা ইভিএমে প্রভাব খাটায়, ব্যালটেও তারা প্রভাব খাটাতে পারে। এ বিষয়টি বন্ধ করতে হবে।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ করে দিতে না পারে, তাহলে নির্বাচন কমিশন ঢাকায় বসে কিছুই করতে পারবে না।

গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল কারণ হলো, ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ। চারটি দল শুধু ইভিএমের পক্ষে, আর বেশির ভাগই বিপক্ষে।

জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাহলে ওনারা ভোটে আসবেন। সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আদালতের এ রায়ের এক সুতার বাইরে সরকার যাবে না। আর বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বলছেন, নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিনি সংসদে গেলেন কীভাবে?

আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, আমরা দেখেছি। তখন কারও ভোটকেন্দ্রে যেতে হতো না। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কী করেছে, সেগুলো কি উনারা ভুল গেছেন?’

বাজেটে পরিবর্তন সামান্যই

অর্থমন্ত্রী গত ৯ জুন যে বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন, তা থেকে খুব একটা বদলাননি তিনি। যেমন, এবারের বাজেটে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শর্ত দেওয়া হয়, এ কর–সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বছরে ১২ লাখ টাকার বেশি নগদ খরচ করতে পারবে না। এ শর্ত শিথিল করা হয় গতকাল বুধবার অর্থ বিল পাসের সময়। এ সীমা করা হয় বছরে ৩৬ লাখ টাকা। ৩৬ লাখ টাকার বেশি বাকি অর্থ লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে করতে হবে। এ ছাড়া একক লেনদেন পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলেও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

এ দুই শর্ত পূরণ করলেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য সাড়ে ২২ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করহার ৩০ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ২৭ শতাংশ আরোপ হবে।

পরিবর্তনের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম দুই বছর কর শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) বিপরীতে শুধু রিটার্ন জমা দেওয়ার বিধান। এখন আর আনুষঙ্গিক প্রামাণিক দলিলপত্র জমা দিতে হবে না। অর্থবিল পাসের সময় গতকাল এ সংশোধনী আনা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে অনুদানকে খরচ দেখানোর আগের নিয়ম বহাল রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া ২০০১ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ এবং ৩০০১ সিসি থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ শতাংশ করা হয়েছে। ২০০০ সিসির বেশি হাইব্রিড গাড়ির সম্পূরক শুল্ক একইভাবে বাড়ানো হয়েছে। এতে দামি গাড়ি আরও দামি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *