জ্ঞানীরা বলেন, পাপ হলো আগুনের মতো। যেভাবে আগুনের ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ বিপদ ছড়িয়ে দিতে পারে, সেভাবে ছোট ছোট পাপও মানুষের বিপদ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মুমিন ছোট-বড় সব ধরনের পাপকে ভয় পায় এবং তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নিশ্চয়ই মুমিন তার পাপকে এমনভাবে দেখে, যেন সে এমন একটি পাহাড়ের নিচে বসে আছে, যা তার ওপর ধসে পড়বে।
নিশ্চয়ই পাপী নিজের পাপকে এমনভাবে দেখে, যেন একটি মাছি তার নাকের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩০৪)
মহানবী (সা.)-এর হুঁশিয়ারি : রাসুলুল্লাহ (সা.) ছোট ছোট পাপের ব্যাপারে আয়েশা (রা.)-কে সতর্ক করে বলেন, হে আয়েশা! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুনাহ থেকেও সাবধান হও। কেননা সেগুলোর জন্যও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৪৩)
পাপ কি ছোট হয় : হাদিসে ব্যবহৃত ‘মুহাক্কারাত’ শব্দের ব্যাখ্যায় হাদিসবিশারদরা বলেছেন, এমন পাপ যার প্রতি মানুষ ভ্রুক্ষেপ করে না। ইমাম মুনাভি (রহ.) বলেন, ‘মুহাক্কারাত হলো ছোট ছোট পাপ। মহানবী (সা.) তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, কারণ তা বড় বড় পাপের পথে মানুষকে পরিচালিত করে। যেমন— ছোট ছোট আনুগত্যগুলো মানুষকে বড় বড় আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত করে। ’ (ফায়জুল কাদির : ৩/১৬৪)
ছোট পাপকে ভয় পাওয়ার কারণ : মুমিনরা ছোট ছোট পাপকেও ভয় পায়। তারা কোনো পাপকেই ছোট করে দেখে না। ছোট পাপকে ভয় পাওয়ার কারণ হলো—
১. ছোট পাপেরও হিসাব হবে : কিয়ামতের দিন বড় পাপের মতো ছোট পাপের জন্যও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পারবে এবং যে অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সেও তা দেখতে পারবে। ’ (সুরা : জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)
২. মহান আল্লাহর অবাধ্যতা : পাপ যত ছোট হোক না কেন তা প্রকারান্তরে মহান আল্লাহরই অবাধ্যতা। সুতরাং পাপকে কখনো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। হেলাল বিন সাআদ (রহ.) বলতেন, ‘তুমি ভেবো না পাপটি ছোট, বরং তুমি ভাবো কার অবাধ্য হলে?’ (হিদায়াতুল মুরশিদ, পৃষ্ঠা ২০৩)
ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (রহ.) বলেন, ‘তুমি পাপকে যত তুচ্ছজ্ঞান করবে আল্লাহর কাছে তা তত বেশি গুরুতর মনে হবে এবং তুমি পাপকে যতটা গুরুতর মনে করবে আল্লাহ তাকে তত তুচ্ছজ্ঞান করবেন। ’ (হিদায়াতুল মুরশিদ, পৃষ্ঠা ২০৩)
৩. আল্লাহর কাছে বড় : মানুষ অনেক সময় কিছু কিছু পাপকে ছোট করে দেখে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তা গুরুতর বিবেচিত হতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে তা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে, যদিও আল্লাহর কাছে তা ছিল গুরুতর বিষয়। ’ (সুরা : নূর, আয়াত : ১৫)
৪. আল্লাহ যদি ক্ষমা না করেন : মানুষের পাপ মার্জনা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা পাকড়াও করবেন। পাপ যত ছোটই হোক এই ভয় থেকে যায়, আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করা ক্ষমা করেন না। এটা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে সে এক মহাপাপ করে। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৮)
৫. সীমা লঙ্ঘনের প্রবণতা বৃদ্ধি করে : ছোট পাপের প্রতি সতর্ক না হলে তা ধীরে ধীরে আল্লাহর অবাধ্যতা ও সীমা লঙ্ঘনের প্রবণতা তৈরি করে। আর আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে তারাই অবিচারকারী। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২৯)
৬. অন্তর কলুষিত করে : পাপ মানুষের অন্তরে ক্ষত ও অন্ধকার সৃষ্টি করে। ছোট পাপেও ক্ষত ও আঁধার তৈরি হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে জং ধরিয়েছে। ’ (সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১৪)
৭. ঈমান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় : ছোট ছোট পাপ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে পাপ কাজে অভ্যস্ত করে তোলে। তাই ছোট ছোট পাপ করতে করতে একসময় মানুষ পাপের জীবন বেছে নেয়। এমনকি মৃত্যুর সময় ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের দৃষ্টিতে যেসব পাপ ছোট তা অন্য পাপের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি একসময় ব্যক্তি মৃত্যুর সময় ঈমান হারিয়ে চির হতভাগ্যে পরিণত হয়। ’ (ইহদাউদ দিবাজা : ৫/৫৬৮)
আল্লাহ সবাইকে পাপ পরিহারের তাওফিক দিন। আমিন।