দেখতে দেখতে ৫০ বছরে পা দিলো কালজয়ী নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এ ছবির স্রষ্টা। প্রযোজক ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছিল এবং ভারতে ১৯৯১-এ। বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র উপযোগী করে নির্মিত হয়েছে।
সিনেমাটি নদী তীরবাসী কিছু মানুষের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতনের রূপময় আলেখ্য। তিতাসের ওপর নির্ভরশীল মালো সমাজের সমস্ত দ্বন্দ্বের রূপায়ণ। সিনেমাটির নিয়ন্ত্রণী শক্তি রক্ত-মাংসের চরিত্রের মতো পরিবর্তিত হয়, কখনো প্রাণদাত্রী কলস্বিনী, সংবরিত স্রোত-উদাসিনী। এই নদীর ওপর মালো সমাজের জীবন-মরণ বাঁধা ছিল। ফলে নদী যখন শুকিয়ে গেল, তখন মালোদের যৌথ জীবনও ভেঙে গেল। অবশ্য সিনেমাটি শেষ হয়েছে নতুন জীবনের ইঙ্গিত দিয়ে।
সিনেমাটির মহরত হয় ১৯৭২-এর ১৪ জুলাই। ১৬ জুলাই শুটিং শুরু হয়। সাভারের একটি বটগাছের নিচে। ৩৪ নং দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণের মাধ্যমে। প্রায় একশ দিন শুটিং হয়েছিল। তবে ছবির পুরা কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এতে অভিনয় করেছেন- কবরী, প্রবীর মিত্র, রোজী সামাদ, খলিল, আবুল খায়ের, গোলাম মুস্তাফা, ঋত্বিক ঘটকসহ অসংখ্য কিংবদন্তী অভিনেতা ও অভিনেত্রী।
সিনেমায় ব্যবহৃত গানগুলো হলো- ওরে নৌকার ওপার গঙ্গা বুঝায়, লীলাবালী লীলাবালী, রাই জাগো, রাধা-কৃষ্ণের মিলন হইলো, কোরানেতে প্রমাণ তার, ও তোর আপন দোষে সব হারাইলি। সিনেমার গানগুলোতে আরোপিত বাদ্যযন্ত্রের আদিখ্যেতা নেই। একেবারে অন্ত্যজ সমাজ, মাটি ও মানুষের জীবনে গানের অপরিহার্য অংশের অবিকৃত উপস্থাপন করা হয়েছে। শব্দ, আবহ সংগীত, রূপক, প্রতীক ব্যবহারে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে সিনেমার দৃশ্যগুলোতে বহুমাত্রিকতা তৈরি করা হয়েছে।
এই সিনেমা তৈরিতে খরচ হয়েছে তখনকার সময়ের ৮ লাখ টাকার কিছু বেশি। তবে তখন বাংলাদেশে একটি সিনেমা তৈরিতে খরচ হতো এক বা সোয়া লাখ টাকায়। সিনেমাটি মুক্তির পর ঢাকায় চারটি এবং চট্টগ্রামে দুটিসহ মোট ছয়টি হলে চালানো শুরু হলো। কিন্তু পরের সপ্তাহে সিনেমাটি হল থেকে নেমে যেতে থাকে দর্শক না পাওয়ায়। হল থেকে দ্রুত নেমে যাওয়ায় সিনেমার টাকা ওঠেনি তেমন। তবে পরবর্তীতে রাশিয়াসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছিল সিনেমাটি। পরবর্তীতে সিনেমাটি কাল্ট ক্লাসিকের মর্যাদা পায়।
এদিকে তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রটি বহুবিধ অর্থজ্ঞাপক বিশাল পরিসরে নির্মিত। উপন্যাসের ব্যপকতা পুরো এক সিনেমায় ধারণ করা সম্ভব না হলেও ঋত্বিক তার কাজের নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। ঋত্বিক নৃতাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সমাজপাঠ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এ চলচ্চিত্রকে। একটি সমাজে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের যে বিশ্বজনীন অশুভ তৎপরতা, তা একটি ছোট্ট কৌমের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক এবং চলচ্চিত্রকার দুজনেই যুগপৎ তুলে ধরেছেন।