বৈরী আবহাওয়া ও তীব্র গরমের কারণে দেশজুড়ে শিশুরা জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় দেশের সব শিশু হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অভিভাবকরা অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলেও কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে রোগী ফিরিয়ে দিতে।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা গেছে, ভর্তি শিশুদের মধ্যে ৫০ শতাংশ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত।
আর স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রোগী ভর্তি বেড়েছে ২০ শতাংশ। তীব্র গরমে এসব শিশু সর্দি, কাশি, জ্বরসহ ডায়রিয়ায় ভুগছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু সংক্রমণও ক্রমেই বাড়ছে। গত জুন মাসে এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৯টি শিশু ভর্তি হয়েছিল। বিপরীতে জুলাই মাসের প্রথম ২০ দিনেই ভর্তি হয়েছে ১৮টি শিশু। অর্থাৎ প্রথম ২০ দিনেই আগের মাসের দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, মাসের বাকি ১০ দিনে আরো রোগী ভর্তি হবে বলে আশঙ্কা করছেন হাসপাতালটির এপিডেমিওলজিস্ট ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন। তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসে জুনের চেয়ে তিন গুণ বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু ভর্তি হতে পারে। ’
গত মঙ্গলবার এক দিনেই এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১২০টি শিশু। এর মধ্যে জ্বর, ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, করোনাভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত শিশু রোগী রয়েছে। হাসপাতালটিতে রোগীর জন্য শয্যা রয়েছে ৮০০টি। বর্তমানে সব শয্যা রোগীতে ভর্তি। একটি শয্যাও খালি নেই। ফলে জরুরি প্রয়োজন কিংবা গুরুতর অসুস্থ শিশু নিয়ে অভিভাবকরা হাসপাতালে এলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে রোগী ফিরিয়ে দিতে।
ঠাণ্ডা-জ্বরে ভুগছে শিশু উমাইয়া। বয়স তিন মাস ১০ দিন। বরিশাল থেকে তাকে নিয়ে এসে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় বসার সামান্য জায়গাটুকুও নেই। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে উমাইয়ার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বাবা এজাজুর রহমানকে।
হাসপাতালটির সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান বলেন, ‘তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শিশু ভর্তি হচ্ছে। এসব শিশুর বেশির ভাগের বয়স শূন্য থেকে ৫ বছরের মধ্যে। পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দু-একটি শয্যা খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য রোগীতে ভরে যাচ্ছে। এ জন্য গুরুতর অসুস্থ অনেক শিশুকেও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। ’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও জুন মাসের তুলনায় দ্বিগুণ চলতি মাসে। গত মঙ্গলবার এক দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনটি শিশু এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে করোনায় আক্রান্ত পাঁচটি শিশু ভর্তি রয়েছে।
এক সপ্তাহ ধরে ঠাণ্ডা-জ্বরে ভুগছে চার বছরের ফাইজ। কুমিল্লা থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে মঙ্গলবার রাতে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। তার করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট এখনো পাননি বলে জানান ফাইজের মা।
আট মাসের ছোট্ট শিশু আফিফা ঠাণ্ডা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে এই হাসপাতালে। নোয়াখালী থেকে বাবা দেলোয়ার (৩৮) তাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, নোয়াখালীতে শ্বাসকষ্ট ও ঠাণ্ডার সুচিকিৎসা না পেয়ে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। দুই দিন হলো এখানে আছেন। মেয়েকে সুস্থ করে বাসায় ফিরবেন—এই তাঁর আশা। দেলোয়ার বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন, আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে, চিন্তার কারণ নেই। এই হাসপাতালে রোগী অনেক বেশি হলেও মোটামুটি সেবাটা পাচ্ছি। ’
এবার গরমে স্বাভাবিক সময়ের মতোই রয়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালটিতে বর্তমানে ১৮টি শিশু ভর্তি রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এই সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের মতোই।
গতকাল শিশু হাসপাতালের আউটডোরে রোগী এসেছে ৮০০ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এদের বেশির ভাগই জ্বর, ঠাণ্ডা ও কাশি নিয়ে এসেছে।
তীব্র গরমে জ্বর-ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়াসহ ডেঙ্গু ও করোনার সংক্রমণও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুর সুরক্ষায় ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ সময়ে হালকা খাবার এবং বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে হবে। বেশির ভাগ শিশুরই জ্বর ও ভাইরাল ফ্লু। এ জন্য দুশ্চিন্তা বা আতঙ্কের কিছু নেই। প্রাথমিকভাবে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হবে। দু-তিন দিন বাসায় রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর অবস্থা খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। ’