গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় শিরিন বেগম (৩২) নামে এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
রক্তশূন্য প্রসূতি ওই রোগীর ‘এ’ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন থাকলেও তাকে পুশ করা হয় ‘বি’ পজিটিভ রক্ত। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসাসেবা দেওয়া জনসেবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত অবস্থায় তড়িঘড়ি করে প্রসূতি শিরিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়।
এ ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসক গা ঢাকা দিয়েছেন। বন্ধ রয়েছে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও।
রোববার দিবাগত রাতে এ ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি সোমবার সকাল থেকে স্থানীয়ভাবে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়।
নিহত প্রসূতি শিরিন বেগম উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী।
ঘটনার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও চিকিৎসকের ব্যবহৃত মুঠোফোন একাধিকবার ফোন ও খুদেবার্তা পাঠিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি।
সরেজমিন সোমবার দুপুরে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। খোলা রয়েছে মাত্র একটি ওষুধের ফার্মেসি। তবে এ ঘটনায় ওই ওষুধ ফার্মেসির কেউ কিছু বলতে রাজি হননি।
মুঠোফোনে জনসেবা হাসপাতালের ব্যবস্থাপক জহির উদ্দিন বলেন, রোগীর খারাপ অবস্থা থাকায় তাকে রোববার রাতে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। তবে ওই রোগী মারা গেছে কিনা তার জানা নেই বলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
রোগীর সঙ্গে থাকা নিহতের স্বামীর বড় বোন হোসনে আরা বলেন, রোববার সকালে আমার ছোট ভাইয়ের বউ হঠাৎ ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় একই এলাকার বাসিন্দা ওই জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগমের কাছে যাই পরামর্শের জন্য। পরে বন্যা বলেন— কোনো চিন্তা করার দরকার নাই, আমি আমার হাসপাতাল থেকে দুজন নার্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই বলে জনসেবা হাসপাতাল থেকে সঙ্গীনি ও পান্না নামে দুই নার্সকে পাঠানো হয় রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরে সেখানে রোগী নিয়ে গেলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিজার করেন ওই হাসপাতালের ডাক্তার মাসুদ। এ সময় প্রসূতি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়ে অপারেষন করার পর ডাক্তার জানান রোগীর জরায়ু ফেটে গেছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, ‘বি’ পজিটিভ রক্ত দরকার লাগবে। তাদের কথামতো ‘বি’ পজিটিভ রক্ত জোগাড় করে রোগীকে দুই ব্যাগ রক্ত পুশ করা হয়। কিন্তু তাতেও রোগী সুস্থ হচ্ছিল না। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। পরে যখন পুনরায় রোগীর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়, তখন জানা যায় রোগীর রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজিটিভ। এর মধ্যে আমাদের ‘এ’ পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে বলে। এখন আবার ‘এ’ পজিটিভ রক্ত কেন? এ প্রশ্ন করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে কোনো সমস্যা নাই। পরে আমরা তড়িঘড়ি করে ‘এ’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহ করি। কিন্তু ‘এ’ পজিটিভ রক্ত পুশ করার কিছুক্ষণ পরেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে রাত ৮টার দিকে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়। পরে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় রওনা দিই। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই ব্যাগ ‘এ’ পজিটিভ রক্তের ব্যাগ রোগীর সঙ্গে দিয়ে দেয়। ঢাকা নেওয়ার পথে রোগীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে, সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান— রোগীকে মৃত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ১০ বছর আগে রোগীর একটি সিজার হয়। ওই সিজারে যমজ সন্তানের জন্ম হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনসেবা হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, এর আগেও এই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এখানে সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক থাকেন না। প্রয়োজন হলে ফোনে ডেকে এনে সিজার করানো হয়।
তিনি আরও বলেন, জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগম একসময় এই হাসতাপালের মূল মালিক ডা. আসাদুজ্জামান আসাদের রোগী দেখার সিরিয়াল দিত। এখন তিনি জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক! কাজেই এখানে কী ধরনের চিকিৎসাসেবা পাবে মানুষ সেটি খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু তার পরও দেখি এখানে রোগী আসে এবং এমন ভুল চিকিৎসার শিকার হন।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এসএম মনজুর-এ-এলাহী জানান, জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাগজপত্র আপডেট নেই। তাদের পুরনো সব কাগজপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তার পরও তার চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।