নবজাতকের কানে আজান ও ইকামত দেওয়া

কোনো মুসলমানের ঘরে যখন কোনো নবজাতকের আগমন ঘটত তখন সর্বপ্রথম তাকে বংশের কিংবা মহল্লা, গ্রাম ও এলাকার কোনো বুজুর্গের কাছে নেওয়া হতো। তিনি নবজাতকের ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দিতেন। মুসলিম পরিবারের এই সংস্কৃতি এখনো সচেতন মুসলিম পরিবারগুলোতে আছে। তবে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান না থাকায় বহু পরিবারের মুরব্বিদের সঙ্গে এই সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে।

 

অথচ এটি রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। রাসুল (সা.) নিজেও তাঁর নাতি হাসান (রা.)-এর কানে আজান দিয়েছিলেন।

উবাইদুল্লাহ ইবনে আবু রাফি (রা.) বলেন, ফাতিমা (রা.) যখন আলী (রা.)-এর ছেলে হাসান (রা.)-কে প্রসব করলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কানে নামাজের আজানের ন্যায় আজান দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১০৫)

শুআবুল ঈমানের বর্ণনায় আছে, ফাতিমা (রা.) যখন আলী (রা.)-এর ছেলে হাসান (রা.)-কে প্রসব করলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ডান কানে নামাজের আজানের ন্যায় আজান দিয়েছিলেন। এবং বাম কানে ইকামত দিয়েছিলেন। (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৮৬২০)

হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে যার সন্তান হয়, সে যেন তার ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দেয়। (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৮৬১৯)

এই হাদিসগুলোর সনদের ব্যাপারে কোনো কোনো মুহাদ্দিসের ভিন্ন মত থাকলেও নবজাতকের কানে আজান ও ইকামত দেওয়া মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরাম একমত।

নবজাতকের কানে কী কারণে আজান দেওয়া হয় এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন, শিশুর কানে আজান-ইকামত দেওয়ার অর্থ হলো তাকে এই কথা বলে দেওয়া যে আজান-ইকামত হয়ে গেছে, এখন শুধু নামাজের অপেক্ষা (নামাজ শুরু হতে সামান্য বিলম্ব, তা-ই তোমার জীবন)।

হজরত থানভি রহ. বলেন, ‘আজান-ইকামতের মাধ্যমে শিশুর কানে প্রথমেই আল্লাহর পবিত্র নাম পৌঁছে দেওয়া, যেন তার প্রভাবে তার ঈমানের ভিত্তি মজবুত হয়ে যায় এবং শয়তান দূরে সরে যায়। এই দুটি হিকমতেরই সারমর্ম হলো দুনিয়াতে আসার পর তুমি আল্লাহকে ভুলে গাফেল হয়ে থেকো না। ’ (তরবিয়তে আওলাদ, হজরত থানভি রহ.)

এ ব্যাপারে আবুল হাসান আলী নদভি রহ. বলেন, আজান ও ইকামত শুধু নামাজের জন্য নির্দিষ্ট। আর নবজাতক শিশু নামাজ তো দূরের কথা—এই আজান-ইকামতের মর্ম ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুই বোঝে না। তাহলে তার কানে আজান-ইকামত বলার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে কোনো কিছু পৌঁছবার আগে শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর নামাজ ও তাঁর ইবাদতের ডাক গিয়ে যেন পৌঁছে।

এ সময় আল্লাহর কোনো বুজুর্গ বান্দার চিবানো খেজুর কিংবা খোরমার একটি টুকরার রস বরকতের জন্য তার মুখে দেওয়া সাধারণভাবে প্রচলিত। একে ইসলামী পরিভাষায় তাহনিক বলে। রাসুল (সা.) থেকে তা সুন্নত হিসেবে প্রমাণিত। আবু মুসা (রা.) বলেন, আমার একটি পুত্রসন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবী (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহিম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। সে ছিল আবু মুসার সবচেয়ে বড় ছেলে। (বুখারি, হাদিস : ৫৪৬৭)

তাহনিকের মাধ্যমে যেমন নবী (সা.)-এর সুন্নত পালনের বরকত অর্জন করা যায়, তেমনি এটি নবজাতককে জন্মের পর স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেও রক্ষা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মের পর নবজাতকের মুখে ঘষে দেওয়া এক ডোজ মিষ্টান্ন প্রিম্যাচুয়ার (অপরিপক্ব) বাচ্চাদের মস্তিষ্কের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হতে পারে। কারণ জন্মের পর লো ব্লাড সুগার প্রতি ১০ শিশুর একটির ওপর খুব বিপজ্জনকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।

নব আবিষ্কৃত এই চিকিৎসাপদ্ধতিকে বলা হয় জেল থেরাপি। নিউজিল্যান্ডের একটি গবেষকদল ২৪২টি শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তার ফলাফলের ভিত্তিতে দাবি করেন যে বর্তমানে এটি প্রথম সারির চিকিৎসা হওয়া উচিত। তাঁদের সেই গবেষণা বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। (বিবিসি)

আমাদের নবীজি (সা.)-এর এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতগুলো যত্নসহকারে পালন করা। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে এই সুন্নতগুলোর ব্যাপারে সচেতন করা এবং সুন্নতগুলো পালনে উদ্বুদ্ধ করা।

 

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *