কীভাবে মানুষের অনুভূতি ও আচরণ সৃষ্টি হয়?

আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে কে? মন নাকি মস্তিষ্ক? মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মনের ভেতর থেকে আসে। মনই চিন্তা, আচরণ ও অনুভূতির কারণ। একবার যদি এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাহলে মানুষ চাইলে তার জীবনের লক্ষ্য খুব সহজেই অর্জন করতে পারে।

স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, মনের ভৌত কাঠামো হল স্নায়ু তন্ত্র।  স্নায়ুবিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখছেন কীভাবে জৈব স্নায়ুতন্ত্র মন তৈরি করে এবং ভৌতভাবে পরস্পর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে মানসিক কার্যক্রম যেমন, রিফ্লেক্স, আবেগ তৈরি, শিক্ষা গ্রহণ, স্মৃতিশক্তি তৈরি ইত্যাদি পরিচালনা করে। কী করে কিছু জৈব কোষের মধ্যে প্রাণীর স্বকীয়তা, আবেগ, উদ্যম বা ইচ্ছা শক্তি তৈরি হয় তা বিজ্ঞানকে ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষের মস্তিস্ক কীভাবে চিন্তাভাবনা করে তা বিজ্ঞানের কাছেও বিষ্ময়।

সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম

বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মন ও শরীরের যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তার মস্তিষ্ক। এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। মানুষের জ্ঞানে-অজ্ঞানে যাবতীয় ক্রিয়া কর্ম এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করে। এটিই সব তথ্য মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, মস্তিষ্ক তা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আমাদের অঙ্গকে কর্মক্ষম করে তোলে।

ব্রেইন স্টিম

মস্তিষ্কের ব্রেইন স্টিম অংশের কাজ হলো রিফ্লেক্স বা প্রতিক্রিয়া তৈরি করা। পাশাপাশি কিছু স্বয়ংক্রিয় কাজও করে থাকে ব্রেইনস্টিম; যেমন হৃদস্পন্দনের হার, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিভিন্ন অঙ্গের সঞ্চালণ ও আন্ত্রিক কাজ পরিচালনা করা।

সংকেত সংগ্রহ

মস্তিষ্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেরেব্রাম; একে সেরেব্রাল কর্টেক্স বা কর্টেক্সও বলা হয়। এর প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যার সমাধান করে তা মোটর নিউরণের সাহায্যে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া। এ ছাড়াও আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিধারণ এবং চিন্তাশক্তির মতো জটিল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করাও এই অংশেরই কাজ। যেমন ধরুন হাতের আঙ্গুলে কোনো বস্তুর স্পর্শ লাগল, এই সংকেত সেন্সরি নিউরন, সেরেব্রাম অঞ্চলে পাঠায় আর এই অঞ্চল সেই সংকেতের বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল অর্থাৎ স্পর্শের গভীরতা, তার অবস্থান, যন্ত্রণা ইত্যাদির অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলি মোটর নিউরনের সাহায্যে আঙ্গুলে পাঠায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান বলছে, মস্তিষ্ক কোনো ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কর্মক্ষম হয় না।

এখন প্রশ্ন হলো মানুষের আবেগ, ভালোবাসা বা বিশ্বাস এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টি হয় কোন ইন্দ্রিয়ের তাড়নায়?

বিজ্ঞান আরও বলছে, মানুষের প্রবৃত্তি মূলক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের নিম্ন ভাগ। আর মস্তিষ্কের উপরের দিকের কয়েকটি বড় বড় অংশ তৈরি করে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা বা বিশ্বাস। মস্তিষ্কের এই অংশে রয়েছে প্যারাইটাল লোব, ফ্রন্টাল লোব, অক্সিপেটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, ইনসুলাসহ আরো কয়েকটি ভাগ।

মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোবের সাথে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চল সংযুক্ত থাকে। এরা শরীরের বহিঃত্বক থেকে আসা বিভিন্ন সংবেদনশীলতা যেমন, চাপ, স্পর্শ ব্যথা ইত্যাদির অনুভব সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় আদেশ নিষেধ প্রদান করে। ভাষার ব্যবহার সহ শ্রবণ-দর্শন সংকেত সংশ্লেষণের কাজও করে এই অংশটি।

মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলটি মেধা ও স্বকীয়তা সৃষ্টির অঞ্চল; মানুষের চিন্তা, বোধ, মননশীলতার মতো জটিল কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এই অংশটি।

তো যদি কেউ তার চিন্তা আবেগ আর অনুভূতি গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায় তাহলে তার কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। আর যদি সে জানতে পারে যে তার মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তাহলে খুব সচেতনভাবেই মানুষ তার জীবনযাপনের ধরণ পাল্টে দিতে পারে। এমনকি মানুষ তার বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি তার দক্ষতাও বাড়িয়ে নিতে পারে।

চিন্তার ধরন

স্বাভাবিকভাবে, মানুষের দুই ধরনের চিন্তাশক্তি কাজ করে- একটি অটোপাইলট আরেকটি ইনটেনশনাল সিস্টেম বা ইচ্ছাকৃত কাজ।

অটোপাইলট

অটোপাইলট মূলত ইনটু্উশন বা অন্তর্দৃষ্টি আর আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়। এটি নির্ভর করে- মস্তিষ্কের এমিগডেলায় ঘটা জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়ার ওপর; যা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এটি মানুষের প্রতিদিনকার অভ্যাসগুলোকেও নির্ধারণ করে থাকে। আবার, দ্রুত কাউকে বিচার করার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভুল সন্দেহও তৈরি হয়ে যায় এই এমিগডেলার কারণে।

ইনটেনশনাল সিস্টেম

এদিকে ইচ্ছাকৃত পদ্ধতি বা ইনটেনশনাল সিস্টেম মানুষকে যুক্তিগত চিন্তায় ধাবিত করে, আর এর সব প্রক্রিয়াই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স দ্বারা পরিচালিত হয়। এই চিন্তাগত পদ্ধতিটি জটিল মানসিক কাজকর্ম পরিচালনার সক্ষমতা দান করে। যেমন- দলগত কাজ সামলানো, সম্ভাবনা ভাবা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা এবং সেই সাথে যৌক্তিকভাবে নতুন ধরনের আচরণ শিখতেও উদ্বুদ্ধ করে।

মস্তিষ্ক যেখানে অটোপাইলট সিস্টেম চালু করতে পারে না, ইনটেনশনাল সিস্টেম বা ইচ্ছাকৃত পদ্ধতি সেখানে কাজ করার স্পৃহা দেয়। অবশ্য প্রশিক্ষণ নিলে একজন ব্যক্তির মধ্যে পজিটিভ আচরণ যেমন নম্রতা-ভদ্রতার মতো বিষয়গুলো নানা পরিস্থিতিতে তাকে সামলানোর প্রেরণা যোগায়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *