মো.শাহেল মাহমুদ, রূপগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানার ৬তলা ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এখনও নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধানের জন্য অপেক্ষা করছেন। বুধবার (২৮ আগষ্ট) বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্যরা পরিদর্শণ করেন।
পরিদর্শণ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, আমি ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেছি তারা উদ্ধার কার্যক্রম পারবেন কিনা, তারা আমাকে জানিয়েছেন ৪, ৫ ও ৬ তলার ফ্লোরটি ধসে গেছে এবং এখনও আগুন রয়েছে। এ মুহুর্তে উদ্ধার কার্যক্রম সম্ভব নয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮ সদস্যর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটি প্রাথমিক ভাবে পরিদর্শণে আসলাম। আমরা দেখি। পরিবর্তীতে আমরা একটি প্রতিবেদন আকারে দিবো। এই হলো আমাদের প্রাথমিক কথা।
তিনি আরো বলেন, অগ্নিকান্ডের বিষয়ে টেকনিশিয়ানরা আমাদের মতামত দিবে। এছাড়া লোকালি যারা ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বে রয়েছেন তারা উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে পারবেন কিনা তা জানাবেন নয়তো আমরা ন্যাশনালী সাপোর্টের জন্য সুপারিশ জানাবো যে এটা লোকালি করা সম্ভব নয়। আরো যারা বেশি টেকনিশিয়ান রয়েছে তাদের সহযোগীতা নিয়ে কার্যক্রম চালাবো। আমরা আশা করি ১০ দিনের মধ্যে একটি তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারবো।
নিখোঁজদের বিষয়ে তিনি বলেন, নিখোঁজদের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে রাখতেছি। আমরা আসলে কয়জন ভেতরে ছিলো বা কয়জন মারা গেছেন আমরা সঠিক ভাবে বলতে পারছিনা। আমরা আমাদের ফায়ার সার্ভিসের যে ড্রোন, সে ড্রোন দিয়ে তারা দেখেছেন। ঐরক মৃত লাশ কিন্তু দেখেননি। আমরা মনে করতেছি যে হয়তো এখানে যেভাবে ক্যামিকেল পোড়ানো হয়েছে যদি আদৌ লাশ থেকে থাকলেও ঐভাবে আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারন ২১ থেকে ২২ ঘন্টা আগুন জলেছে, ততক্ষনে লাশের কিছু পাওয়ার মতো অবস্থা নেই। আপনারা বুঝতেই পারছেন ৩ থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যেই একটি লাশ কয়লা হয়ে যাওয়ার কথা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগীতাও নেয়া হবে। ভেতরে কি হয়েছে বা বর্তমানে কি আছে এ বিষয়টি উদঘাটনের চেষ্টা করবো।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, শতাধীকের বেশি লোকজন ভেতরে ছিলো বলে আমরা স্থানীয় ভাবে জানতে পেরেছি। তবে, যারা নিখোঁজ রয়েছেন, স্বজনদের পক্ষ থেকে তাদের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের ব্যপারে গুরুত্ব দিয়ে দেখ। তবে, অনুপ্রবেশকারী ঢুকলে কিছু লোকজন নামতে পারেননি হয়তো তারা মারা গেছেন।
পরিদর্শণে উপস্থিত ছিলেন, তদন্ত কমিটির সদস্য নারায়ণগঞ্জ গ সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের উপ-মব্যবস্থাপক রাজিব চন্দ্র ঘোষ, নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাস এন্ড টি এন্ড টি কোম্পানির ব্যবস্থাপক মঞ্জুর আজিজ, নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ-১ এর উপ মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী হরেন্দ্র নাথ বর্মন, নারায়ণগঞ্জ-২ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর উপসহকারী পরিচালক আব্দুল মান্নান ও রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল।
জানা গেছে, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানা রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ০৫ আগষ্ট স্বৈরাচারি আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ শত শত লোকজন ও লুটপাটকারীরা লাঠিসোটা নিয়ে রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানায় প্রবেশ করে ভাংচুর ও মালামাল লুটপাট শুরু করেন। এক পর্যায়ে ওই দুটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে রূপগঞ্জের নবকিশোলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামী গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার এবং নারায়ণগঞ্জ আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করার পর আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ খবরের পরই গত (২৫ আগষ্ট) রোববার সন্ধ্যার দিকে কয়েক শতাধীক লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে রূপসী গাজী টায়ার কারখানার সামনে ও ভেতরে ঢুকে পরে। এরপর আবারো ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করেন। স্থানীয় বেশ কিছু বিএনপি নেতাকর্মীরা এসে ভাংচুর ও লুটপাটে বাঁধা দিলে তা না মেনে ভাংচুর ও লুটপাট চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ভেতরের ৬তলা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন কয়েক শতাধীক লোকজন। ওই ভবনে ক্যামিকেল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিলো। ভবনের ভেতরে লুটপাট নিয়ে দুটি পক্ষের মাঝে হাতাহাতি ও মারপিটেয়র ঘটনা ঘটে। এসময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পুরো ভবনে আগুন লেগে যায়। এসময় আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে আগুনের লেলিহান শিখা ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচুতে উঠে পড়ে।
ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন। খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমড়া ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট টানা ৩দিন কাজ চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ১৭৬ জন ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছে বলে স্বজনরা দাবি করেছেন। বেশির ভাগ নিখোঁজদের বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, মুড়াপাড়াসহ আশ-পাশের এলাকার।###