গাজার সমুদ্র এখন কেবলই মৃত্যুর নীরব সাক্ষী

দখলদার ইসরাইলের নৃশংস বর্বরতায় এক লাখেরও বেশি মানুষ গাজা থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী মিশরে আশ্রয় নিয়েছেন। মোনা তেমনই এক মানুষ। গর্ভবতী অবস্থায় গাজা থেকে মিশরে পালিয়ে এসেছিলেন এই নারী। মিশরে তার থাকার স্থায়ী জায়গা নেই।

বরাবরই সমুদ্রের ধারে থেকেছেন মোনা। গাজায় তার বাড়ি থেকে সমুদ্র ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। মন খারাপ হলে অথবা হতাশ লাগলে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। তিনি গাজার যুদ্ধ সব কিছু বদলে দিয়েছে। সমুদ্র এখন মৃত্যুর নীরব দর্শক সাক্ষী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকবার আশ্রয়শিবির বদলাতে হয়েছে মোনাকে।

কীভাবে ইসরাইলের ড্রোন আর বিমান হামলা থেকে বেঁচেছেন, তা ভাবলে শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা রক্তের স্রোত অনুভব করেন মোনা। দুই শিশুকে নিয়ে গর্ভবতী মোনা কোনোভাবে মিশরে পালিয়ে বেঁচেছেন। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে’কে তিনি বলেছেন, একদিনে যে পরিমাণ মৃত্যু দেখেছি, কষ্ট দেখেছি, তা বলার নয়।

স্বামীকে গাজায় ছেড়ে এসেছেন মোনা। প্রতি রাতে ঘুমের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। মনে পড়ে স্বামীর কথা। মোনা জানিয়েছেন, বাচ্চাদের নিয়ে মিশরে পালাতে তার খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। আত্মীয়-পরিজন যারা বিদেশে আছেন, তাদের সাহায্যে ওই টাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। স্বামীর আসার মতো আর টাকা ছিল না।

এখনও পর্যন্ত আহত এবং অসুস্থ মানুষদের গাজা থেকে মিশরে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। বিদেশের দূতাবাসগুলোও কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাজার বাসিন্দাদের পালাতে সাহায্য করছে। মিশরের একটি সংস্থাও এই কাজে নেমেছে। কিন্তু তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে হচ্ছে। ওই সংস্থার সঙ্গেই মিশরে পৌঁছেছেন মোনা।

মোনা যে সংস্থার সাহায্যে পালিয়েছেন, শোনা যায় তা সরাসরি মিশরের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে জড়িত। তবে মিশরের প্রশাসন এই অভিযোগ এখনো পর্যন্ত অস্বীকার করেছে।

মিশরে এই মুহূর্তে ঠিক কত ফিলিস্তিনি আছেন, তার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না। মিশরের সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি অনেক সময় এক লাখ বলা হয়। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, সংখ্যাটি অনেক বেশি। সমস্যা হলো, যারা মিশরে পালিয়ে এসেছেন, মৌলিক অধিকারটুকুও তাদের নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ– কোনো পরিষেবাই পাচ্ছেন না তারা।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ম্যানডেট বা নিয়মাবলির মধ্যেও পড়ে না ফিলিস্তিন। ফলে সাধারণ সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন এই শরণার্থীরা। ফলে এই শরণার্থীদের সম্পূর্ণভাবে মিশরের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবকদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যারা তাদের কাছে খাবার, অর্থ, পোশাক পৌঁছে দিচ্ছে।

এদিকে ফিলিস্তিনের শরণার্থী মিশরে যত বাড়ছে, তত অন্য আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। মিশরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো না। কিছুদিন আগেই মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দার বিরুদ্ধে বহু মানুষ পথে নেমেছিলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছিল। শরণার্থীর সংখ্যা বাড়লে পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মিশর জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের তারা স্থায়ীভাবে রাখতে চায় না। কিন্তু শরণার্থীদের ইসরাইলের সেনা গাজায় ফিরে যেতে বাধা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মোনা জানেন না, তিনি গাজায় ফিরে যেতে পারবেন কি না। আপাতত সে কথা ভাবার চেষ্টাও করছেন না তিনি। কায়রোয় পৌঁছে মোনার আলাপ হয়েছিল লুসির সঙ্গে। লুসির নামও পরিবর্তন করা হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। লুসি এক জার্মান নারী প্রায় দুই দশক ধরে কায়রোয় আছেন। এই মানবাধিকার কর্মী মোনার জীবন বদলে দিয়েছেন। মোনার সমস্ত দেখভাল এখন তিনি করেন। ইতোমধ্যে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন মোনা। ছয় বছরের মেয়ে, চার বছরের ছেলে আর সদ্য জন্মানো সন্তানকে নিয়ে লুসির সাহায্যে বেঁচে আছেন মোনা।

মোনা একা নন, মিশরজুড়ে এমন আরো অনেক মোনা প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন। পালিয়ে এসেও তারা শান্তিতে নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *