ছাত্র-জনতার রক্তে স্নাত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকার যাতে ব্যর্থ না হয়, সেটি বিগত স্বৈরশাসকের গুটিকয়েক উচ্ছিষ্টভোগী ছাড়া দেশের সর্বস্তরের মানুষের একান্ত প্রত্যাশা। সরকার গঠনের দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এ সময়ে সরকারের পক্ষে জনগণের কল্যাণ ও দেশের যে অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব ছিল, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা এখন সবার কাছে বিবেচ্য বিষয়। সেই সঙ্গে ব্যর্থতার জন্য সরকার ও দেশের অনাগত বিপদগুলো সক্রিয় বিবেচনায় রাখা দরকার।
সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরাসহ আগস্ট বিপ্লবের নায়কদের জন্য সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ। পুরো সংবিধান বা সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ এখনো বাতিল বা স্থগিত হয়নি। ফলে ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সংঘটিত করেছেন এবং তারা ওই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সুতরাং, আওয়ামী লীগ যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তাহলে ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, তা সুনিশ্চিত। যদি বিএনপি বা অন্য কেউ ক্ষমতায় আসে এবং তারাও যদি উক্তরূপ শাস্তি দিতে চায়, তাও আইনানুগভাবে পারবে, যদি না সংবিধান যথোপযুক্তভাবে সংশোধন বা নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমে যথোপযুক্ত রক্ষাকবচ প্রদান না করা হয়। সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান রচনা বা অন্য কোনো আইনের মাধ্যমে উক্তরূপ রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে গেলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক তা অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে করতে হবে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশের আয়ুষ্কাল সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে ৩০ দিন। যদি ওই সময়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংসদে পাশ না হয় বা সংসদ কর্তৃক বাতিল করা হয়, তাহলে তা অকার্যকর হয়ে যাবে। সুতরাং, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের রক্ষাকবচ এবং সরকারের সব কাজকর্মের বৈধতার জন্য পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তন্মধ্যে একটি হলো, সংবিধান সংস্কারবিষয়ক। অন্য পাঁচটি কমিশনের যৌক্তিকতা থাকলেও সংবিধান সংস্কারবিষয়ক সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিশনটি অপ্রয়োজনীয়, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, যেখানে অপশন দুটি, সেখানে যে কোনো একটি নির্ধারণ করে সে সম্পর্কিত খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত ‘কমিটি’ (কমিশন নয়) গঠন করাই সমীচীন। তবে সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনাই শ্রেয় বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়নে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সচিবের বেশির ভাগ পদগুলোয় স্বৈরশাসকের লোকজন বসে আছে। এছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা রয়েছে। কিছু পদে আবার স্বৈরশাসকের লোকজনকে চুক্তিভিত্তিক বসানো হচ্ছে। যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রচার করা হচ্ছে। যোগ্য লোকের অভাব নেই বরং খুঁজে না পাওয়ার জন্য এ সংক্রান্তে দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উপযুক্ত দৃষ্টিশক্তি অথবা সদিচ্ছার অভাবই মূল কারণ। স্বৈরশাসকের সাড়ে ১৫ বছরে অবসরে যাওয়া, কিন্তু বঞ্চিত আড়াই হাজার কর্মকর্তা অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। তাদের অন্যায়ের প্রতিকারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন মাস সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এটি একটি উপহাস ব্যতীত কিছু নয়। কারণ, বঞ্চনার সব তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রয়েছে, তাহলে আলাদা কমিটি কেন? বরং কর্মরত জনবল দিয়ে অনায়াসে ১৫ দিনের মধ্যে তা সম্পন্ন করা যায়। তাদের মধ্যে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা, যারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। তাদের বিভিন্ন সংস্থার শূন্যপদসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পদগুলোয় স্বল্প সময়ে নিয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া কর্মরত কর্মকর্তারা, যারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছিলেন, তাদের প্রায় চারশজনকে সরকার ইতোমধ্যে পদোন্নতি দিয়েছে। তারাও সরকারের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন হেতু তাদের মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে অতি দ্রুত পদায়ন করা জরুরি।
পুলিশে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের অভাবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও মামলার তদন্ত দুটোই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি স্বৈরশাসকের কিছু রাঘববোয়াল এবং মারাত্মক অপরাধী ধরা পড়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৪ ধারা অনুযায়ী দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বা কোনো আলামত উদ্ধার বা সহযোগী অপরাধীদের গ্রেফতার, এমনকি সহযোগীদের নাম-ঠিকানা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে দেখা যায়। বরং আসামিরা এসি রুমে থাকছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। অপরাধের পুলিশি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ভারতের সিবিআই-এর আদলে নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের কোনো উদ্যোগ বা আলোচনা লক্ষ করা যায় না। স্বৈরশাসকের মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী সব ব্যক্তির দায়মুক্তির সনদ প্রদানকারী সেই দুদকই রয়ে গেছে। ফলে দুর্নীতির মামলার সুষ্ঠু তদন্ত সুদূরপরাহত। আর যে কোনো ফৌজদারি মামলার তদন্ত সঠিক মতো না হলে অপরাধী অপরাধ করেও বিচারে খালাস পেয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রকৃত অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত বিচার একান্ত জরুরি; যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এজন্য বিচার পদ্ধতির পরিবর্তন করা অত্যাবশ্যক। এছাড়া রাজধানীর বিচারালয়সহ বিচার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় স্বৈরশাসকের জনবল কর্মরত রেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে আছে। সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। সেখানে প্রশাসক বসানো হয়েছে। দু-একটি বাদে সব জায়গায় প্রশাসকরা নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। বেশির ভাগ কাউন্সিলর স্বৈরশাসকের তল্পিবাহক হওয়ায় তারা পলাতক রয়েছেন। ফলে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে, যে কারণে জনগণের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো শতভাগ অচল।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে অভিভাবকশূন্য, অর্থাৎ ভিসি নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রয়েছে। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীকে সমগ্র বাংলাদেশে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১২(১) ও ১৭ ধারা অনুযায়ী ৬০ দিনের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।
ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। আরও কয়েকটি কমিশন গঠন করা জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়; যেমন: স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা, ভূমি, আর্থিক খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য খাত ইত্যাদি। কমিশনকে তিন মাস সময় দেওয়া অনেক বেশি বলে মনে হয়। সর্বোচ্চ দুই মাস সময় দেওয়া যথার্থ বলে অনুমিত হয়।
মনে রাখতে হবে, সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয় বরং মনোনীত। দিন যতই যেতে থাকবে, সরকারের জনপ্রিয়তার পারদ ততই নিচের দিকে নামতে থাকবে এবং জন ও সেনাসমর্থন উভয়ই কমতে থাকবে। সুতরাং, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সবার জন্য মঙ্গলজনক।
ড. মোহা. আবদুস ছালাম : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব