রহস্যঘেরা গাড়ি জব্দ

1_3454নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় নূর হোসেনের বাসভবনে ব্যাপক আকারে ‘রহস্যময়’ অভিযান চালিয়েছে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথ বাহিনী। ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য টানা সাড়ে ছয় ঘণ্টার অভিযানে বাড়িটির প্রতিটি অংশে তল্লাশি চালায়। এ সময় বাড়ির ভেতর থেকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগযুক্ত একটি মাইক্রোবাস ও রক্তমাখা একটি শার্ট জব্দ করা হয়েছে। নূর হোসেনের এক সহযোগীর কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মুঠোফোন। অভিযানকালে বাড়ির ভেতর থেকে ১৬ জনকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আটকের সত্যতা স্বীকার করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া জানিয়েছেন, সাত হত্যার বিষয়ে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ওই বাড়ি থেকে আর কী কী আলামত পাওয়া গেছে সে ব্যাপারে পুলিশের কোনো কর্মকর্তাই রাজি হননি মুখ খুলতে। অভিযানকালে কোনো সংবাদকর্মীকেও বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বেলা ১টার দিকে গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মীকে গেটের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলেও তাদের দোতলার কোনো কক্ষে যেতে দেওয়া হয়নি। এদিকে সাত অপহরণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনায় শোক আর আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হওয়া নারায়ণগঞ্জে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হচ্ছে। হত্যার প্রতিবাদ, খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে আজকের এ হরতালের ডাক দিয়েছিল জেলা আইনজীবী সমিতি।

সাত হত্যার প্রতিবাদ ও খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলররা আজ থেকে দুই দিন অবস্থান ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। কাউন্সিলরদের বৈঠক শেষে নাসিকের প্যানেল মেয়র-১ ওবায়েদুল্লাহ জানান, নারায়ণগঞ্জ নগর ভবনের সামনে দুদিনের অবস্থান ধর্মঘট শেষে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন কাউন্সিলররা।

যেভাবে চলে অভিযান : সকাল ১০ টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত টানা সাড়ে ছয় ঘণ্টার অভিযানে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ, আর্মড পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যরা অংশ নেন। অভিযানের নেতৃত্বে দেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক। তবে মামলার মূল আসামি নূর হোসেনকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের একটি সূত্র জানান, সকাল ১০টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়-সংলগ্ন টেকপাড়ায় নূর হোসেনের রহস্যময় বাড়িটির চারপাশ ঘেরাও করে ফেলে পুলিশ। বাড়ির সামনে ও প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক গাড়ি ও সাঁজোয়া যান। পৌনে ১১টার দিকে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেন পুলিশ সদস্যরা। তল্লাশি চালিয়ে বাড়ির ভেতর থাকা কালো মার্কারি গ্লাসে আবৃত একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-০৫১০) তারা জব্দ করেন। প্রাথমিকভাবে মাইক্রোবাসটিতে ছোপ ছোপ রক্তমাখা দাগ দেখতে পান তারা। পরে গাড়িটি কর্ডন করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ও নারায়ণগঞ্জ সিআইডিকে খবর দেয় পুলিশ। বেলা ১২টায় ঢাকা থেকে ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ টিম ও নারায়ণগঞ্জ সিআইডি জব্দ গাড়ি থেকে আলামত সংগ্রহ শুরু করে।

এ সময় পুলিশ সদস্যরা নূর হোসেনের বাড়ির ভেতর উত্তর পাশের দোতলা ভবনের ওপর ও নিচতলায় এবং দক্ষিণ পাশের পৃথক দোতলা ভবনের সব কক্ষে তল্লাশি চালায়। অভিযানের শুরু থেকেই গণমাধ্যমকর্মীদের নূর হোসেনের বাড়ির ভেতর প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়। সোয়া ৩টার দিকে কয়েকজন সংবাদকর্মী বাড়ির ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেলেও ২০-২৫ মিনিট পর তাদের বেরিয়ে যেতে বলা হয়।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ : পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাইক্রোবাসটির আলামত সংগ্রহ করতে থাকে। এ সময় সেখান থেকে আলামত সংগ্রহকারী টিম রক্তের নমুনা ও একটি রক্তমাখা শার্ট সংগ্রহ করে। এর কিছু সময় পর তল্লাশি অভিযানে থাকা ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক খান, নারায়ণঞ্জ জেলা সুপার ড. মহিতউদ্দিনসহ পুলিশ কর্মকর্তারা বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন। একই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি কালো মাইক্রোবাস নূর হোসেনের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। ওই দুটি গাড়িতে করেই আটকদের নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।

শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিদায়ের পর নূর হোসেনের বাড়ির ভেতর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষে থাকা কাপড়চোপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ি থেকে শুরু করে শো-পিস, ক্যালেন্ডার পর্যন্ত নামিয়ে তল্লশি চালানো হয়েছে। বাড়ির ভেতর কোনো গোপন কক্ষ আছে কি না তাও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। চেয়ার, টেবিল, আলমারিসহ আসবাবপত্র খোলামেলা ও এলোমেলোভাবে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। তবে উত্তরের দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ও দক্ষিণের রহস্যে ঘেরা ভবনে পুলিশ কী ধরনের তল্লাশি চালিয়েছে, সেখান থেকে কী কী আলামত পাওয়া গেছে, সে ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি পুলিশের কোনো কর্মকর্তা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বললেন : বেলা ৩টায় নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান থেকে বের হয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া (হেডকোয়ার্টার) সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্তত ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এরা নূর হোসেনের পরিবারের কেউ নন। তবে এদের মধ্যে তার তিন সহযোগী রয়েছেন। তাদের আটকের কারণ জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সেভেন মার্ডারের ঘটনায় তারা সম্পৃক্ত কি না বা তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন কি না সে বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। হাইয়েস মাইক্রোবাসটি জব্দের বিষয়ে তিনি জানান, ওই গাড়িটিতে ছোপ ছোপ লাল দাগ রয়েছে। একটি শার্টেও লাল দাগ পাওয়া গেছে। তবে এটি রক্তের দাগ কি না তা বলা যাবে ফরেনসিক বিভাগের পরীক্ষা শেষে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মতিন ১৬ জনকে আটকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি জানান, আটকদের কাছে খুন হওয়া আইনজীবী চন্দন সরকারের মুঠোফোন পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করে অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, গ্রেফতারকৃতরা সেভেন মার্ডার মামলার এজাহার-নামীয় না হলেও তারা আসামিদেরই ঘনিষ্ঠজন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. মহিতউদ্দিন জানান, সেভেন মার্ডার মামলার আসামিরা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেনি। তারা দেশেই আছেন। অচিরেই তাদের গ্রেফতার করা হবে।

নারায়ণগঞ্জে আজ হরতাল : নারায়ণগঞ্জে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। সাতজনের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ, খুনিদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে রোববার (আজ) সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের ডাক দিয়েছে জেলা আইনজীবী সমিতি। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ইতিমধ্যে ১৪ ও ১৯-দলীয় জোটের নেতারা হরতালের সঙ্গে একাত্দতা প্রকাশ করেছেন। শান্তিপূর্ণ ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই পালিত হবে এ হরতাল। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল বিকেলে জেলা আইনজীবী সমিতির অংশগ্রহণে পালিত হয় মানববন্ধন কর্মসূচি। জেলা আইনজীবী সমিতির চলমান আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে আরও রয়েছে ৫ এপ্রিল ফুল কোর্ট রেফারেন্স ও ৬ এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আদালত বর্জন। এর আগে নারায়ণগঞ্জে প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি মাহাবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা থেকে সারা দেশে কর্মসূচি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হবে। এদিকে হরতালে সমর্থন দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি, বাসদ, জাসদ, গণসংহতি ও সাংস্কৃতিক জোট এবং সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠন ।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল জানান, কেন্দ ীয় বিএনপি এ হরতালকে সমর্থন দিয়েছে। তাই হরতালের সমর্থনে শহরে নিতাইগঞ্জ, কালীবাজার ও খানপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় শনিবার পথসভায় সাধারণ মানুষকে হরতালে একাত্দতা প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে কালীবাজার এলাকায় সন্ধ্যায় পাঞ্জাবি পরা বেশ কয়েকজন ব্যক্তি উচ্চ স্বরে স্লোগান তুলতে থাকেন, ‘রোববার কোনো দোকানপাট খুলবে না। গাড়ির চাকা ঘুরবে না।’ এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

হরতাল প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. মহিতউদ্দিন বলেন, ‘আমরা লক্ষ রাখব, হরতালে জানমালের যেন ক্ষতি না হয়। সেদিকে লক্ষ রেখে জনগণের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাব। আমরা আশা করব কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না।

বা প্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *