আতঙ্ক নগরী নারায়ণগঞ্জে রহস্যের শেষ নেই। গতকাল নতুন করে শামীম ওসমানের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নূর হোসেনের ভাইয়ের প্রাইভেট কারটি জব্দ করা হয়েছে। এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বিকালে প্রকাশ্য প্রতিবাদ সমাবেশ করে রহস্যময় একটি অডিও সিডি প্রচার করেছেন। ওদিকে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর হাজি শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, ছয় কোটি টাকা নিয়ে র্যাবের সিও এবং দুই মেজর ওই সাতজনকে অপহরণের পর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এ ঘটনার পেছনে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, নূর হোসেনও দায়ী। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব দাবি করেন।
এদিকে সাতজনকে গুম-খুনের প্রতিবাদে ডাকা হরতালের দিনে গতকাল সাবেক এমপি, বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিনের সমর্থকরা হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, দখল করে নিয়েছে হাজি বদরুদ্দিন সুপার মার্কেটটিও। এর আগে গত শনিবার নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা মাইক্রো উদ্ধার ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। ওই বাড়ি থেকে আটককৃত ১৬ জনকে অজ্ঞাত স্থানে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর হাজি শহিদুল ইসলাম দাবি করলেন, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব ও তাদের সহযোগীরা সাতজনকে অপহরণপূর্বক হত্যা করেছে। এদিকে রক্তমাখা গাড়ি, শার্ট, মোবাইল উদ্ধার, অডিও সিডি প্রকাশ ও ছয় কোটি টাকা লেনদেনের খবরে ঘটনার রহস্যময়তা আরও বাড়ল।
কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর যা বললেন: নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর পরিকল্পিতভাবে হত্যায় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, নূর হোসেন এবং পুলিশ-র্যাবের কিছু সদস্যকে দায়ী করলেন কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর হাজি শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও দাবি করেছেন, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী দুটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন দুই-চারজন কর্মকর্তার সরাসরি হস্তক্ষেপে নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।
শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার আপন ভাই হাসমত আলী হাসুর অ্যাকাউন্ট থেকে দুই কোটি টাকা একজন কর্মকর্তার কাছে পৌঁছানো হয়েছে। নূর হোসেনের সব টাকা আমার ভাই হাসুর কাছে। আর বাকি চার কোটি টাকা নূর হোসেন, ইকবাল ও হাজি মো. ইয়াসিনের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, ‘অপহরণের পর প্রথমে এদের নামে মামলা করার জন্য আমরা থানা এবং এসপির কাছে গিয়েছিলাম। তারা মামলা নেয় নাই। উল্টো আমারে দুই দিন ঘুরাইছে। নজরুলের মা বারবার ফোন করে হেদের (তাদের) কাছে মিনতি করছে। কইছিলো মরা লাশ দিয়েন না, জিন্দা দেন- দরকার হলে আজীবনের জন্য দেশের বাইরে চইল্যা যামু। কিন্তু হেরা তার কথায় কান দেয় নাই।’
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকে সন্দেহের তীর কেন? জানতে চাইলে হাজি শহীদ বলেন, ‘ঘটনার দিন ২৭ এপ্রিল বেলা পৌনে ২টার দিকে অপহরণের পর যেখান থেকে অপহরণ করা হয়েছে সেখানে আমি গিয়েছিলাম। ওইখানে কিছু শ্রমিক বালুর কাজ করছিল। তারা বলেছে, র্যাব-১১ লেখা একটি গাড়ি তাদের তুলে নিয়ে গেছে। এমপির পরামর্শে লোকজন নিয়ে আমি র্যাব-১১ এর কাছে যাই। তবে তারা দেখা না করতে চাইলে বেলা সোয়া ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জ পুরাতন কোর্ট র্যাব-১১ এর কার্যালয় ঘেরাও করি। পরে আমার সঙ্গে থাকা ৪-৫ জনকে ভিতরে নিয়ে সব মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় ও সেগুলো বন্ধ করে দেয়। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে খারাপ ব্যবহার। টানা ৬ ঘণ্টা আমাদের সেখানে আটকে রাখা হয়।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি র্যাবের সিও তারেক, মেজর জাহাঙ্গীর ও মেজর এম এ রানাসহ ১৩ জনের নামে মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেছেন, তাদের নামে মামলা করলে মামলা টিকবে না। তিনি অভিযোগ করেন, এসপি নূরুল এ হত্যাকাণ্ডে টাকা খেয়ে সহায়তা করেছেন। মামলা থেকে যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তারা হলো- র্যাবের সিও তারেক, মেজর জাহাঙ্গীর ও মেজর এম এ রানা, শাহজাহান, নূর উদ্দিন (নূর হোসেনের ভাই), জামাল উদ্দিন, আলিম, মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, আরিফুল হাসান। সুষ্ঠু তদন্ত করলে আমার অভিযোগ সব প্রমাণিত হবে।
স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে সব কিছু অচল ছিল
সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল গোটা নারায়ণগঞ্জ। কাকডাকা ভোর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল পুরো নগরী। একের পর এক অপহরণ, হত্যা ও গুমের প্রতিবাদে নগরবাসীর জমে থাকা দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যেন ঘটেছে গতকাল জেলা আইনজীবী সমিতির ডাকা হরতালে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
গতকাল সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই নগরীতে রিকশাসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল সব ধরনের দোকানপাট। সকাল ৭টার দিকে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে একটি বাস (নারায়ণগঞ্জ-ব-০২-০০৭৩) ভাঙচুর ছাড়া আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে সকাল ৭টায় শহরের চাষাঢ়া এলাকায় অবস্থিত নূর মসজিদের সামনের রাস্তায় একটি বাস ভাঙচুর করে হরতাল সমর্থকরা। একই সময় হরতাল সমর্থকরা মিছিল করে নারায়ণগঞ্জ-কমলাপুর রেলপথের চাষাঢ়া এলাকায় রেলপথ অবরোধ করে রাখে। বন্ধ হয়ে যায় রেল যোগাযোগ। নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার গোলাম মোস্তফা জানান, সকালে ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে একটি ট্রেন ছেড়ে এলেও হরতাল ও রেলপথ অবরোধের কারণে সেটি আর নারায়ণগঞ্জে আসতে পারেনি।
নারায়ণগঞ্জের নতুন পুলিশ সুপার জানান, জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
হরতালের সমর্থনে সকাল ১০টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে আইনজীবীরা সমাবেশ করেন। সেখানে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, সাত খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করছে।
বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, ন্যাপ, গণসংহতি আন্দোলন, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকি মঞ্চসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ হরতালে সমর্থন দিয়েছিল। বেলা দেড়টায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান দীপুর নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে আইনজীবীদের সমাবেশে যোগ দেন। এ সময় সমাবেশে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য দিলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা সরকারের পক্ষে পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় সমাবেশে সামান্য উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর তার সমর্থকদের নিয়ে চলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
হরতালের সমর্থনে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে শহরের ২ নং রেলগট এলাকায় সমাবেশ শেষে মিছিল বের করে ত্বকি মঞ্চ। সমাবেশে বক্তারা বলেন, জনগণের সঙ্গে দুষ্টমি ও মশকরা করে কেউ টিকতে পারেনি। জনগণের সঙ্গে দুষ্টুমি করেছিল ইয়াহিয়া খান, এরশাদ, বিএনপি- তারা টিকে থাকতে পারেনি।
পথসভায় উপস্থিত ছিলেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকি মঞ্চের আহ্বায়ক রাফিউর রাবি্ব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক তরিকুল সুজন প্রমুখ। সভায় অবিলম্বে ৭ মার্ডার মামলার আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়।
একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় বিএনপি শহরের ২ নং রেলগেট এলাকায় জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ সভা করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার, বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলম, এ টি এম কামাল, মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, জান্নাতুল ফেরদৌস, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন প্রমুখ।
এদিকে সহকর্মী হত্যার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একটি গোষ্ঠী ও পরিবার জড়িত।
প্রাইভেট কার জব্দ
নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সিদ্ধিরগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে সাত হত্যা মামলার আসামি নূর হোসেনের অবৈধ দখলকৃত দোকানপাট, অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছে নজরুল ইসলাম সমর্থকরা। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নজরুল সমর্থকরা একত্রিত হয়ে এ ভাঙচুর চালায়। এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ নূর হোসেনের ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার এফ প্রিমিয়াম (ঢাকা মেট্রো-২৯-৮৮-৬২) উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টায় নজরুল সমর্থকরা শিমরাইল মোড় এলাকায় হাজি বদরুউদ্দিন সুপার মার্কেটে অবস্থিত নূর হোসেনের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনের মালিকানাধীন বদরুউদ্দিন সুপার মার্কেটটি ১/১১-এর পরবর্তী সময়ে নূর হোসেন দখল করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও শিমরাইল মোড়ের ডিএনডি খালের ওপর সরকারি জমি দখল করে নূর হোসেনের অবৈধভাবে গড়ে তোলা বেশ কয়েকটি দোকানেও ভাঙচুর চালিয়েছে গিয়াস উদ্দিনের সমর্থকরা।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে শিমরাইল মোড়ে নূর হোসেনের আস্তানা খ্যাত ট্রাক স্ট্যান্ডে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ট্রাক স্ট্যান্ডের পেছনে অবস্থিত জি এম গ্লাস নামক একটি গ্লাস কারখানার ভেতর থেকে নূর হোসেনের ব্যবহৃত প্রাইভেট কার উদ্ধার করেছে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেডকোয়ার্টার) জাকারিয়া অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে জানান, অভিযানকালে জিএম গ্লাস কারখানার ভেতর থেকে নূর হোসেনের ব্যক্তিগত গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।বা প্র