নারায়ণগঞ্জে বহুল আলোচিত সাত অপহরণ ও হত্যার সাত দিন পর একটি বাড়ি ঘিরে পুলিশের ব্যাপক অভিযান, রক্তমাখা গাড়ি জব্দ ও আইনজীবী চন্দন সরকারের মুঠোফোন উদ্ধারের ঘটনা ক্রমেই রহস্যময় হয়ে উঠছে। অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন সহযোগীদের নিয়ে পালিয়ে গেলেও ছোপ ছোপ রক্তমাখা মাইক্রোটি ‘অপরাধের আলামত’ হিসেবে নিজের বাসায় রেখে গেলেন? সাত অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলার মধ্যেই নিহত আইনজীবীর মুঠোফোনটি কে বা কারা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছিলেন? আর নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়েই পুলিশ তাকে বা তাদের পেয়ে গেল? এসব প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। এদিকে শনিবার অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেফতারের দাবি জানালেও গতকাল পর্যন্ত তাদের কারও নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। তারা জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে কী ধরনের তথ্য দিচ্ছে কিংবা আদৌ কোনো তথ্য দিচ্ছে কি না সেসব বিষয়ে মুখ খুলছে না পুলিশ।
তবে আলোচিত এ অপহরণ ও হত্যা মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চারটি বিষয় সামনে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নানা তথ্যসূত্র তাদের হাতে পেঁৗছেছে। এরই মধ্যে নানা পয়েন্ট খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের অপহরণপূর্বক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি তদন্তে জেলা ও ঢাকার অন্তত ১০টি টিম মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। অপহরণের পর হত্যার শিকার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে এলাকার আধিপত্য বজায় রাখা, রাজনৈতিক প্রভাব-বলয় সৃষ্টি ও ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে কাউন্সিলর নূর হোসেনের সঙ্গে চরম দ্বন্দ্ব ছিল। উভয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জেরে সিদ্ধিরগঞ্জে একের পর এক লাশ পড়েছে। চলেছে পাল্টাপাল্টি জিঘাংসার নানা ঘটনা। নব্বইয়ের দশক থেকে নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের বিরোধ চলে আসছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অন্য আসামিরাও হাত মেলায় নূর হোসেনের সঙ্গে। ঘটনার দিন নজরুল ইসলাম মূল টার্গেট থাকলেও অন্যরা ঘটনার শিকার হয়েছেন বলেই মনে করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সর্বশেষ বিরোধ রাস্তা নিয়ে
এদিকে এলাকা পর্যায়ে অনুসন্ধানে বিরোধের আরও একটি কারণ বেরিয়ে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে এ বিষয়টিও কাজ করেছে কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। সূত্রটি জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মৌচাক এলাকা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরীপাড়া বাজার হয়ে মিজমিজি পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়নের কাজ নিয়ে সম্প্রতি নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের বড় ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। তানভীর মজুমদার নামের এক ঠিকাদার ফেব্রুয়ারিতে সড়কটির উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। নিজ এলাকায় কাজ হওয়ায় ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে তা তদারকির দায়িত্ব দেন সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। রাস্তাটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে চৌধুরীপাড়া এলাকায় মোবারক হোসেন ও জালাল নামে দুই ব্যক্তির বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধাগ্রস্ত হন ঠিকাদার। মোবারক হোসেনের চালের আড়তের শাটার থেকে কিছু অংশ পেছনে সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানানো হয়। আর জালাল দাবি করেন, মোবারক জায়গা ছেড়ে দিলে তিনি ছাড়বেন। এ নিয়ে কাউন্সিলর নজরুল দুজনের সঙ্গে কথা বলেন। এদিকে মোবারক কাউন্সিলর নূর হোসেনের খালাতো বোনের জামাতা। তিনি নূর হোসেনকে বিষয়টি জানালে এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।
একপর্যায়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি দুই কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে চৌধুরীপাড়া এলাকায় সালিশ-বৈঠক হয়। স্থানীয়রা জানান, বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর নূর হোসেন ও নজরুল ইসলামের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। পরে নূর হোসেন খবর দিলে শিমরাইল এলাকা থেকে ১০-১২টি মাইক্রোবাসে করে লোকজন এসে ওই এলাকায় হামলা চালায়। তারা চৌধুরীপাড়ার ২০-২৫টি দোকান ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে গুলি ও বোমা ফাটায়। এ সময় নজরুল ও তার সহযোগীরা ভয়ে এলাকা ছাড়েন। ওই হামলার নেতৃত্ব দেন নূর হোসেন, ইয়াছিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন, শাহজালাল বাদল, ইকবাল হোসেনসহ কয়েকজন। এ ঘটনা ঘটিয়ে নূর হোসেনের পক্ষ উল্টো নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করে। মোবারক বাদী হয়ে নজরুল ও তার সহযোগীসহ ১৬ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন। এরপর এলাকায় ফিরতে পারছিলেন না নজরুল।