ডেস্ক রিপোর্ট সাম্প্রতিক সময়ে চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অসাধু চাল কল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটির মতে, গত তিন মাসের ব্যবধানে চালের দাম ১০ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। এই মূল্য কারসাজিতে ৩৩টি রাইস মিল জড়িত। গোয়েন্দা সংস্থার এ বিষয়ক রিপোর্ট সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তবে রাইস মিল মালিকরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহবায়ক কেএম লায়েক আলী সমকালকে বলেন, কৃষকদের ন্যায্য দাম পেতে ধানের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সরবরাহ কম থাকায় দামে প্রভাব পড়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের পুঁজি বিনিয়োগসহ অন্যান্য মজু“ারি খরচ যোগ করা হলেও কোনোভাবেই প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের মানসিকতা মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে কার্যকর তদারকি দরকার।
এতে বলা হয়, ব্যবসায়ীরা সরকারি মজুদের স্বল্পতা ও কৃষকের ধান কম সংরক্ষণ করার সুযোগ নিচ্ছে। চলতি বছর বোরো ধানের মৌসুমে ধান ও চালের মূল্য স্বাভাবিক ছিল। কৃষকদের কাছ থেকে চাতাল ও মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে সাপ্লাই চেইনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এনে বেশি দামে বিক্রি করছে। প্রতিবেদনে দাম বৃদ্ধির আরও কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ফেব্র“য়ারি-এপ্রিল মাসে কৃষকদের হাতে ধানের মজুদ না থাকায় মজু“ার ও মিল মালিকরা কারসাজি করে দাম বাড়ান। এ ছাড়া
বাজারে টিসিবির শক্তিশালী প্রভাব নেই। ফলে এখনও বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ ছাড়া ধানের মোকাম থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চাল পৌঁছাতে ৪/৫টি হাত বদল হয়। প্রতিবার হাত বদলেই বাড়ে চালের মূল্য। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত চাল পৌঁছাতে এর দাম ৫-৬ টাকা বৃদ্ধি পায়। ঢাকার বড় ব্যবসায়ীরাও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছেন। এ ছাড়া পরিবহন খরচ, বিভিন্ন চাঁদা, বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি চালের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে।
যাদের নামে অভিযোগ : গোয়েন্দা রিপোর্টে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারসাজির সঙ্গে ৩৩টি মিলের জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ৫টি মিল রয়েছে। মিলগুলো হলো রশীদ এগ্রো ফুড প্রডাক্টস, স্বর্ণা অটো রাইচ মিল, দাদা অটো রাইচ মিল, ব্যাপারী অটো রাইচ মিল ও বিশ্বাস এগ্রো ফুড । নওগাঁর সাত মিলের মধ্যে রয়েছে বন্ধু চালকল, বেলকোন অটো, নাদিয়া ফুড অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডা. প্রা. লি., নজিবুর রহমান চালকল, মেসার্স বিসমিল্লাহ অটো চালকল, মেসার্স সবুজ অটো রাইচ মিল, মেসার্স সজীব চাল কল।
দিনাজপুরের চৌদ্দটি মিলের নাম রয়েছে। এগুলো হলো জাবেদা অটো রাইস মিল, নরশিন জেরিন অটো রাইস মিল, হামিদা অটো রাইস মিল, কাঞ্চন অটো রাইস মিল, দরদী অটো রাইস মিল, অঞ্জলী অটো রাইস মিল, হাসের অটো রাইস মিল, আছিয়া অটো রাইস মিল, সোহা অটো রাইস মিল, বেঙ্গল অটো রাইস মিল, আদর অ্যান্ড দরদী অটো রাইস মিল, ভাই ভাই হাসকিং মিল, মানিক ট্রেডার্স, বাদল ট্রেডার্স ও এমআর অটো রাইস মিল। পঞ্চগড়ের তিন মিলের মধ্যে রয়েছেথ মেসার্স এসবি অটো রাইস মিল, মেসার্স ফাহাত অটো রাইস মিল ও মেসার্স আবদুল্লাহ অটো রাইস মিল ও মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজ অটো রাইস মিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিন মিলের মধ্যে রয়েছেথ নবাব অটো রাইস অ্যান্ড ফিড প্রাইভেট লি., হক অটো রাইস মিলস এবং মেসার্স এরফান অটো রাইস মিলস।
মতামত জানতে চাইলে দিনাজপুরের কাঞ্চন অটো রাইস মিলের মালিক মোসাদ্দেক হোসেন মুকুট বলেন, ‘কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ আমাদের নেই। বাজার থেকে ধান কিনে তা চালে রূপান্তরিত করে বিক্রি করি। আমাদের চাল মজুদ করার কোনো
সুযোগ নেই।’
কুষ্টিয়ার দাদা রাইচ মিলের জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘গত দেড় মাস আমাদের মিল বন্ধ রয়েছে। চলতি বছর আমাদের ব্যবসায় লোকসান দিতে হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে পারিনি। কারসাজি করলে এই করুণ অবস্থা থাকত না।’
তিনি আরও বলেন, শুধু মিলারদের দোষারোপ করলে হবে না। সরবরাহ কম থাকায় কিছু মিল সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াতে পারে। তবে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৭০০ মিল চাল উৎপাদন করছে। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই।
কিছু সুপারিশ :চালের মূল্য বৃদ্ধি রোধে ৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চিহ্নিত মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফা লাভের ধারা থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে । এ ছাড়া চাল কল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সুদের হার সহনীয় রাখতে হবে। বাজারে মনিটরিং বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে যাতে নির্দিষ্ট সময়ের পরও খাদ্য গুদামজাত করতে না পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ধানের জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ভিজিএফ, ভিজিডি ও টিআর কর্মসূচি চালু এবং ওএমএস পদ্ধতিতে খোলা বাজারে চাল ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।সমকাল