ডেস্ক রিপোর্ট : রাজধানীর বনানীতে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, ধানম-ি, গুলশান ও নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে গড়ে উঠেছে সারি সারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ব্যস্ততম সড়কের পাশে ও আবাসিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না করার সরকারি বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। শিক্ষার্থী ভর্তি করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লোর ভাড়া নিয়ে, মার্কেটের
ভেতরে, রেস্টুরেন্টের ওপরে, বাসস্টেশনে এমনকি কারওয়ানবাজারের কাঁচাবাজারের পাশেও গড়ে তুলেছে ক্যাম্পাস। সম্প্রতি মূল ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ২০১৩ থেকে সময়সীমা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। ফলে নিজস্ব ক্যাম্পাসে ফেরার উদ্যোগ থমকে গেছে।
সরেজমিন বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি), সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি নিয়ে মোট ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এই কয়েকটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস সংখ্যা ২৮টি, যার মধ্যে শুধু এআইইউবি ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস রয়েছে ১১টি। এ সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। আবার কয়েকটির রয়েছে বহুতল ভবন। সেই ভবনগুলোর নিচতলায় দোকান, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ তলায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিস এবং পঞ্চম তলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম।
ধানম-ি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধানম-ি ২ নম্বর সড়ক থেকে শুরু করে ঝিগাতলা হয়ে ২৭ নম্বর পর্যন্ত প্রধান সড়কের পাশে আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি ক্যাম্পাস। আশপাশের অলিগলিতে রয়েছে আরও কিছু ক্যাম্পাস। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এ আবাসিক এলাকার ভাড়া বাড়িতে। ধানম-ি ২ নম্বর সড়কে পপুলার হাসপাতালের পাশে ছয়তলা নিজস্ব বাড়িতে রয়েছে দারুল ইহ্সান ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বিজনেস স্টাডিজ। ধানম-ি ৪/এ সড়কের ১৪৯/১ নম্বরে ছয়তলা বাড়ির পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক। বিপরীত পাশে একই ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের ক্যাম্পাস। ধানম-ি লেক থেকে কিছুদূর এগিয়ে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ ক্যাম্পাস। এরপর নিজস্ব ভবনে গড়ে উঠেছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। শংকর পার হয়ে ধানম-ি ২৭ নম্বরের মাথায় নিজস্ব ভবনে রয়েছে স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। ধানম-িতে আরও আছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ইউনিভাসির্টি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে ১৭টি : প্রতিষ্ঠার সাত বছর পর সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থিত হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে পাঠদান শুরু করেছে। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপন করেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে-নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিটি ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয় ও রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়। আর প্রতিষ্ঠার পর সাত বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়া ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় যেতে পারেনি নিজস্ব ক্যাম্পাসে। প্রতিষ্ঠার পর সাত বছর অতিক্রান্ত না হওয়ায় বাকি ২৪টির নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
ভাইস-চ্যান্সেলর বিহীন বিশ্ববিদ্যালয় : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর ও ট্রেজারার পদ অপরিহার্য বলে বিবেচিত হলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান সরকার নিযুক্ত ভাইস-চ্যান্সেলর, প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর ও ট্রেজারার ছাড়া চলছে। ইউজিসি থেকে জানা যায়, বর্তমানে ২৯টি বিশ্ববিদ্যালেয় ভাইস-চ্যান্সেলর, ৪৯টিতে প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর ও ৪৫টিতে ট্রেজারার নেই। নিয়মিত উপাচার্য না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং, রয়েল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, চিটাগাং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, নটের ডেম ইউনিভার্সিটি, টাইমস ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রণদা প্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া।
মালিকানা সমস্যা ও আউটার ক্যাম্পাস বাণিজ্য : মালিকানা দ্বন্দ্ব নিয়ে সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ হচ্ছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে চারটি পক্ষ বিবাদে সক্রিয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে—ধানম-ির মূল ক্যাম্পাসের ঠিকানার ইয়াকুব লতিফউল্লাহ পক্ষ, সাভারের গণকবাড়ির ঠিকানার বজলে রাব্বি পক্ষ, মিরপুরের আকবর উদ্দিন পক্ষ এবং উত্তরার আবুল হোসেন পক্ষ। জানা গেছে, এই চার পক্ষ মিলে সারাদেশে শতাধিক অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। এ রকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্রাইম ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি ট্রাস্টি বোর্ড উত্তরায়, আশফাক উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি ট্রাস্টি বোর্ড মিরপুরে নিজেদের মূল কর্তৃপক্ষ দাবি করে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে। মারাত্মক মালিকানা দ্বন্দ্বে লিপ্ত আরেকটির নাম ইবাইস ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০২ সালে ধানম-িতে প্রতিষ্ঠা করেন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া লিঙ্কন। এরপর ২০১১ সালে জাকারিয়া লিঙ্কন ইবাইস ইউনিভার্সিটি ফাউন্ডেশন এবং শওকত আজিজ রাসেল ইবাইস ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট গঠন করে। বর্তমানে ধানম-ির মূল ক্যাম্পাস রাসেল গ্র“পের আর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ে লিঙ্কন গ্র“পের ক্যাম্পাস চলছে। এই তিনটি ছাড়াও সম্প্রতি ইউজিসির কঠোর অবস্থানের কারণে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও রয়েল ইউনিভার্সিটি মালিকানা বিরোধ মিটমাট করে নেয়।
এদিকে আউটার ক্যাম্পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করার পরও কার্যক্রম বহাল রাখছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি পল্টন ক্যাম্পাসে, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম ঢাকায় আউটার ক্যাম্পাসে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দেয়। তবে এখনও বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম শহরে একাধিক আউটার ক্যাম্পাসে, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি রাজশাহী ও খুলনায় এবং ইউআইটিএস ঢাকায় ছাত্রভর্তি বহাল রেখেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর ও ইউজিসির প্রাক্তন পূর্ণকালীন সদস্য ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ অবস্থার কারণে আজকে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার মান নিম্নমুখী। একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস-চ্যান্সেলর, প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর, সিন্ডিকেট ছাড়া চলতে পারে না। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে সরকারের এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়ায় আমরা গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে শিক্ষার্থীদের সচেতন করেছি। এরপরও ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হলে এই দায় তাদের। আর আউটার ক্যাম্পাস বন্ধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবার সময় দেওয়া হচ্ছে। এরপরও নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে না পারলে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।