নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে মাথায় আঘাত করে গলায় রশি দিয়ে বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তবে তাদের বুকেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। বুধবার দুপুরে জেলা সিভিল সার্জন দুলাল চন্দ্র চৌধুরী নিজ অফিস কক্ষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। মৃতদেহ ভেসে না ওঠার জন্য পেটে নাভির পাশে ছিদ্র করে দেওয়া হয়েছিল বলে জানান দুলাল চন্দ্র চৌধুরী । সূত্র জানায়, যে পেশাদার কিলাররা পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দেয়। তবে কোথায় বসে কখন তাদের হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, র্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেয়ায় কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনগণ। স্থানীয়দের অভিযোগ, র্যাবের ওই সিও এমন ও কোন অপরাধ নেই যা তিনি করতেন না। শ্বশুর মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তিনি র্যাব সদর দপ্তর পুলিশ সদরদপ্তরের কারো কমান্ড মানতেন না। শোনা গেছে, এ ঘটনার পর র্যাব-১১ এর ওই সিও তারেক তার শ্যালক দীপু চৌধুরির সঙ্গে এ ঘটনা নিয়ে বৈঠক করেন। তার ছোট শ্যালক রনি চৌধুরি সঙ্গে ও বিষয়টি শেয়ার করেন। এরপর রনি চৌধুরি দেশের বাইরে চলে গেলে দীপু চৌধুরি তাকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। শোনা গেছে দিপু চৌধুরি নুর হোসেনসহ অন্যদের অবস্থান সম্পর্ক অবহিত আছেন। তিনি ও চেষ্টা করেছিলেন নুর হোসেনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর শক্ত অবস্থান এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর খুনীদের গ্রেপ্তারে কঠোর নির্দেশ দেয়ায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় দিপু চৌধুরির।
এদিকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে হত্যায় র্যাবের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন চাঁদপুরের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ছেলে। এই দাবি করেছেন নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম। সম্প্রতি সংঘটিত আলোচিত অপহরণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনার মূল অভিযুক্ত নারায়ণগঞ্জের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের পক্ষে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যের ছেলে এই চুক্তি করেন। শহীদুল জানান, ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে নজরুলকে হত্যা করার এই পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানতে পেরেছেন এমন একজনের কাছ থেকে যিনি উভয় দিকে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ২৭ এপ্রিল নজরুল এবং তার ৪ অনুসারীকে অপহরণ ও হত্যার প্রায় এক সপ্তাহ আগে হত্যাকারীদের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি আরো জানান, অপহরণের ঘটনার পরে এই লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করেন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও নারায়ণগঞ্জ হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অবশ্য শহীদুলের এই দাবি কতটা সত্য তা যাচাই করা যায়নি বলে আওয়ামী লীগের ওই সংসদ সদস্য ও তার ছেলের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। শহীদুলকে নূর হোসেনের সহযোগী ওই ‘এজেন্ট’ জানিয়েছিলেন যে, অপহরণের এক সপ্তাহ আগেই এক গোপন বৈঠকে ওই হত্যাকান্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। শহীদুলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ওই ‘ডাবল এজেন্ট’ দাবি করেন, গোপন ওই বৈঠকটিতে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। অপহরণের ঘটনার ৪ দিন আগে তিনি হত্যাকান্ডের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে শহীদুলকে জানান এবং নজরুলকে কোনো গোপন আস্তানায় পাঠিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন।
শহীদুল বলেন, এমনিতেই নজরুল প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছিলেন। তাই প্রায় দুই মাস আগে থেকেই নজরুল নিজের এলাকার বাইরে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তাই আমাকে সতর্ক করে দেয়ার পরেও বিষয়টিকে আমি খুব একটা আমলে নিইনি। তিনি জানান, র্যাবের সঙ্গে হত্যাসংক্রান্ত এই চুক্তি যিনি করেছিলেন তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য তো বটেই, এমনকি সরকারের মন্ত্রিসভাতেও তিনি আছেন। ওই এজেন্টের দেয়া তথ্য অনুযায়ী- নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যা মামলার প্রধান তিন আসামি নূর হোসেন, হাজী ইয়াসিন এবং হাসমত আলীই ওই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত করেছিলেন। হাসমত হলেন শহীদুলেরই ছোট ভাই যিনি পারিবারিক বিরোধের জের ধরে পরিবার থেকে বিছিন্ন হওয়ার কারণে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব সদস্যরা নজরুলকে হত্যা করেছেন বলে এই চমকপ্রদ তথ্য প্রথমবারের মতো গত রোববার সামনে আনেন শহীদুল।
শহীদুল জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে অপহরণের ঘটনার জানার প্রায় পরপরই আদমজীতে অবস্থিত র্যাব- ১১’র হেডকোয়ার্টারে তিনি গেলেও সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার তাকে সেখানে প্রায় ছয় ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বিষয়টি নিয়ে ক্রমাগত ঠাট্টা-তামাশা করছিলেন। এরপর ওই কমান্ডিং অফিসারসহ র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য শহীদুল ও তার মেয়ে সেলিনা ফতুল্লা থানায় গেলে পুলিশও মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরের দিন নূর হোসেন, হাজী ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী, আমিনুল ইসলাম, আনোয়ার ও ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন সেলিনা। মামলার অভিযোগে সেলিনা জানান, প্রায় দুই মাস আগে মিজমিজি এলাকায় একটি সড়ক নির্মাণের কাজ নিয়ে বিরোধের জের ধরে তার স্বামী নজরুলকে অপহরণ করেছেন নূর হোসেন।
স্থানীয়রা জানান, নজরুল ও নূর হোসেনের মধ্যে প্রতিদ্বতান্দ্বিপূর্ণ এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয় ২০০০ সালে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের জন্য উপজেলা নির্বাচনেও লড়াই করেছিলেন এই দুই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে বেশ কয়েকবার তাদের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।