রাজধানীতে আইন অমান্য করে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। ঢাকায় ছোট-বড় দুই লক্ষাধিক শিল্প-কারখানা থাকলেও প্রায় ৬০ হাজার গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে, ঠিক আবাসিক এলাকাতেই। নাগরিকদের জন্য এসব কারখানা শুধু বিড়ম্বনারই নয়, রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবেশবিদদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ কারখানার ভবনগুলো যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়াসহ কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অগ্নিকাণ্ডের মতো নানা দুর্ঘটনার। সেই সঙ্গে শব্দসহ নানা ধরনের দূষণ ঘটাচ্ছে ওই সব কারখানা। এত সব ঝুঁকির মধ্যেই বহু পরিবার মিল-কারখানাগুলো ঘেঁষে অবস্থান করছে গলাগলি ধরে। কিন্তু নানা ঝুঁকি ও বিপন্নতার মুখেও আবাসিক এলাকা থেকে কল-কারখানা সরানোর বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর পুরান ঢাকা খ্যাত ১০টি থানা এলাকায় রয়েছে কমপক্ষে ৫৫ হাজার অবৈধ কারখানা। এগুলোর শতকরা ৮৫ ভাগেরই অবস্থান আবাসিক ভবন বা বাসাবাড়িতে। ভবনগুলোর অধিকাংশই আবার পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিকসহ দাহ্য পদার্থ ও জ্বালানি তেল। যে কোনো মুহূর্তে এসব ভবন ধসে পড়া, অগ্নিকাণ্ডসহ রয়েছে নানা দুর্ঘটনার আশঙ্কা। সূত্র জানায়, রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবৈধ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকায়। এসব কারখানা একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি তারা প্রতিবছর চুরি করছে সরকারের কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস। ঘনবসতি, প্রচণ্ড তাপ, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের এসব কারখানায় কাজ করছে হাজার হাজার শ্রমিক। পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, ইসলামবাগ, বংশাল, কোতোয়ালি, চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর, সূত্রাপুর, কদমতলী, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, গনি মিয়া ঘাট, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, পোস্তা, ওয়াটার ওয়ার্কস, শহীদনগরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে বহু বছর ধরে চালু রয়েছে হাজার হাজার শিল্প-কারখানা। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব শিল্প-কারখানা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্দক হুমকি। শুধু যে পুরান ঢাকাজুড়েই মিল-কারখানা গজিয়ে উঠেছে তা নয়, রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে কল-কারখানা গড়ে ওঠেনি। মিরপুর, শ্যামলী, রামপুরা, বাসাবো, বনানী, উত্তরা, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, গুলশান, বাড্ডা, ইস্কাটন, মৌচাক, মালিবাগ, শংকর, মোহাম্মদপুরসহ আবাসিক-অনাবাসিক সর্বত্র অবস্থান পোশাক কারখানার। কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই রাজধানীসহ চারপাশে ক্রমবর্ধমান হারে গড়ে ওঠা গার্মেন্টগুলো একসময়ের আশীর্বাদ হলেও এখন তা নাগরিকদের জন্য রীতিমতো পরিণত হয়েছে অভিশাপে। গার্মেন্টগুলো পরিবেশের জন্য তেমন একটা ক্ষতিকর নয় মনে হলেও এসব কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত বর্জ্য, অসহনীয় শব্দ মানবদেহের জন্য মারাত্দক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে ভারী ও মাঝারি আকারের শিল্প-কারখানার জন্য একসময় তেজগাঁও নির্ধারিত থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মহানগরীতে। গুলশানের মতো অভিজাত আবাসিক এলাকাতেও এখন গড়ে উঠেছে দূষণ সৃষ্টিকারী মিল-কারখানা। উত্তরা মডেল টাউনের কোনটা আবাসিক, কোনটা বাণিজ্যিক কিংবা শিল্প এলাকা তা বোঝার সাধ্য নেই।
শব্দদূষণে বেহাল : মানবদেহে শব্দের সহনশীল মাত্রা ৫০ থেকে ৭০ ডেসিবল। কিন্তু ঢাকায় কল-কারখানার অনবরত ঘরঘর শব্দ, জেনারেটরের অতি উচ্চ শব্দ, যানবাহন চলাচলসহ হাইড্রোলিক হর্ন, বিভিন্ন স্থানে ইটভাঙা মেশিনের শব্দের মাত্রা ১৬০ থেকে ২০০ ডেসিবল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। কল-কারখানা, বর্জ্য-ধোঁয়া মিলিয়ে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রাও অস্বাভাবিক। দেহের জন্য যেখানে প্রতি কিউবিক মিটার বাতাসে মাত্র ৫০ মাইক্রোগ্রাম পার্টিকুলেট ম্যাটার সহনীয়, সেখানে ঢাকার বাতাসে এয়ারবোর্ন পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম। শুধু বায়ুদূষণের শিকার হয়েই প্রতিবছর মৃত্যু ঘটছে এখানকার প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর। বাতাসে সিসার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় বিশ্বের দূষণযুক্ত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা শীর্ষে। যানজটের ভয়াবহতা আর কালো ধোঁয়ার আগ্রাসনে অসুস্থ হয়ে পড়ছে নগরজীবন। কল-কারখানাগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ কালো ধোঁয়া ত্যাগ করে, তা বিনা বাধায় আকাশে-বাতাশে ছড়িয়ে দূষণ ঘটাচ্ছে পরিবেশের।
কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল বর্জ্য গিয়ে দূষিত করছে রাজধানীর নদী, নালা, নর্দমা, খাল-বিল, ঝিল। এমনকি অনেক কারখানা পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচে বিষাক্ত বর্জ্য ঠেলে দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও পড়তে যাচ্ছে দূষণের কবলে। ঢাকার আশীর্বাদ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীসহ পানির উৎসগুলো পরিণত হয়েছে দুর্গন্ধময় ময়লার উৎসে।
অকার্যকর আইন : শব্দদূষণ রোধে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭, যানবাহন আইন ১৯৮৩, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন ১৯৭৬ থাকলেও এ অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নাগরিকরা। নগরীর শব্দদূষণ রোধে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রণয়ন করা হয় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা। বিধিমালায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটার পর্যন্ত হর্ন বাজানো নিষেধ। আইনে আবাসিক এলাকার ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ভ্রাম্যমাণ আদালত, তবু দূষণ : পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ও ইটিপি ছাড়া যত্রতত্র কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়। তৎপর থাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম। দোষীদের জেল-জরিমানার দণ্ড দেওয়া হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। এত কিছুর পরও শিল্প-কারখানার অব্যাহত দূষণ থেকে রাজধানীবাসী রেহাই পাচ্ছে না কোনোভাবেই। গত দুই বছরে শুধু পরিবেশ অধিদফতর দূষণের অভিযোগে রাজধানীসহ আশপাশের অন্তত ৬৫টি শিল্প-কারখানায় অভিযান চালিয়েছে। এসব কারখানাকে পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী করে প্রায় ২০ কোটি টাকা জরিমানা আদায়সহ নয়জনকে কারাদণ্ডও প্রদান করা হয়েছে। বা প্র