পদ্মা সেতুর পর এবার দেশের দীর্ঘতম ফ্লাইওভার প্রকল্পে (মগবাজার-মৌচাক) নকশা পর্যালোচনা এবং তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগে ব্যাপক জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এতে একদিকে সরকারের বড় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে, জালিয়াতির মাধ্যমে কম যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে কাজ করানোর কারণে গোটা প্রকল্পটির ভবিষ্যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেক। খবর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
সূত্রে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্মেক স্থানীয় তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে টেন্ডারে অংশ নেয়। কিন্তু, যে ক্রাইটেরিয়া ও যেসব শর্তে এ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথম গ্রহণযোগ্য দরদাতা বিবেচনা করা হয়েছিলো এবং কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিলো, কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তা চরমভাবে লঙ্ঘন করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পে কাজ করার কথা টেন্ডারে উল্লেখ করা হয়েছিলো তা পরে পরিবর্তন করা হয়। জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ পরিবর্তনের বিষয়টি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি নাকচও করে দিয়েছিলো। তারপরও প্রধান প্রকৌশলী পিপিআর লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজে নিজেই এটি অনুমোদন করেন। এমনকি এতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এতে ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান (ডিপিপি) এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, ২০১২ সালের ১২ জুন থেকে ১৭ মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক স্মেক (এসএমইসি) ইন্টারন্যাশনাল এবং দেশিয় এসিই কনসালট্যান্ট লিমিটেড, এসএআরএম কনসালট্যান্ট লিমিটেড ও ক্রান্তি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড নামক যৌথ পরামর্শক সংস্থার সঙ্গে ১৩ কোটি ৭ লাখ টাকার চুক্তি করে এলজিইডি। চুক্তির পর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) লঙ্ঘন করে ডেপুটি টিম লিডার (ডিটিএল) ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার পরিবর্তন করে পরামর্শক সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই খাম বিশিষ্ট দরপত্রে টেকনিক্যাল অফারই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। টেকনিক্যাল অফার মূল্যায়নে নম্বর বেশি থাকে এবং বিশেষ করে এর ভিত্তিতেই গ্রহণযোগ্য দরদাতা বিবেচিত হয়। টেকনিক্যাল লোকবল অর্থাৎ কোন কোন বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কাজ করবেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ওপর নম্বর দেওয়া হয়। গ্রহণযোগ্য দরদাতা নির্বাচনের জন্য এসব ক্ষেত্রে এটাই প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়। টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তন করা হলে প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই টেন্ডার গৃহীত হওয়ার পর টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। কখনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তনের অপরিহার্যতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে নিয়ম হলো, টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় যার নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো পরবর্তী অর্থাৎ নতুন ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা তার সমান অথবা তারচেয়ে বেশি থাকতে হবে। পূর্বের ব্যক্তির চেয়ে কম হলে তা কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ব্যক্তি পরিবর্তনের এই পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করবে পূর্বের মূল্যায়ন কমিটি, যে কমিটি ইতিপূর্বে টেন্ডার মূল্যায়ন করেছিলো। মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পর তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে তাদের বোঝায়, ইতিপূর্বে টেন্ডার বা কার্যাদেশ চূড়ান্ত করার সময় যেসব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিলো। এটাই হলো পিপিআরর শর্ত।
পিপিআর ২০০৮ এর ১১৯ (৫) ধারায় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (কী পারসনাল) পরিবর্তন করা যাবে না। পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয় হলে তা পুনরায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) কর্তৃক মূল্যায়ন করতে হবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। অথচ এসব নিয়ম না মেনেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পে বিধি বহির্ভূতভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কী পারসনদের পরিবর্তন করা হয়েছে।
তথ্যানুযায়ী, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে স্মেকের সঙ্গে সম্পাদিত মূল চুক্তিতে ডিটিএল (ডেপুটি টিম লিডার) ছিলেন আব্দুল মান্নান। তার পরিবর্তে ফরিদ আহমেদকে নেওয়া হয়েছে। এবং ষ্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন জাপানের ড. হিদো ম্যাতসুসিমা। তার পরিবর্তে রবার্ট জে আ্যাবেসকে নেওয়া হয়েছে। অথচ প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা বেতন গ্রহণকারী এই নতুন ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট জে অ্যাবেস এ সংক্রান্ত কোনো ডিজাইনই তৈরি করতে পারেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পিপিআর অনুযায়ী পিইসির পুনঃমূল্যায়ন হলে নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শক সংস্থা স্মেক কাজের অযোগ্য হয়ে যেত। চুক্তির শর্তেই তা বলা আছে। এক্ষেত্রে কাজ পেতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডিপিএম-এআইএ জেবি নামে প্রতিষ্ঠানটি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেত। এতে রাষ্ট্রের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো।
অপরদিকে ষ্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট জে আ্যাবেস অদক্ষ হওয়ায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)কে চার কোটি টাকা চুক্তিতে ডিজাইন কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়েছে। কিন্তু ডিপিপিতে ওই প্রকল্পের জন্য কেবলমাত্র একটি পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের শর্ত রয়েছে। ডিজাইন মূল্যায়ন এবং কাজ তদারক করার দায়িত্ব ওই একটি সংস্থারই থাকার কথা। সেই অনুযায়ীই স্মেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ফ্লাইওভারটির ডিজাইন তৈরি বাবদ পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেকর এখনকার কাজ হলো সেই ডিজাইন মূল্যায়ন এবং তদারক করা।
অথচ ডিপিপি লঙ্ঘন করে স্মেক-এর বাইরে অতিরিক্ত পরামর্শক হিসেবে বুয়েটকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ডিজাইন মূল্যায়নের জন্য। যেহেতু স্মেকর নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন মূল্যায়ন করতে পারছে না সে কারণেই এটি করতে হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের অতিরিক্ত চার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বাবদ সরকারের প্রায় ৯ কোটি টাকা গচ্ছা গেছে শুধুমাত্র দুর্নীতিবাজদের সরকারি অর্থ আত্মসাত প্রবণতার কারণে।
সূত্র মতে, এরমধ্যে পাঁচ কোটি টাকার একটি বড় অংশ গেছে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানের পকেটে। স্মেক তাদের অস্ট্রেলিয়াস্থ সদর দফতরের এজেন্টের মাধ্যমে এই অর্থের লেনদেন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানের ছেলে এবং মেয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। সেখানে ওয়াহিদুর রহমান বিভিন্নভাবে প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন। কিনেছেন বাড়ি-গাড়ি। শীর্ষ কাগজের ৩১তম সংখ্যায় অস্ট্রেলিয়ায় ওয়াহিদুর রহমানের ক্রয় করা দু’টি বাড়ি এবং একটি গাড়ির ছবি, ঠিকানাসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পরামর্শক সংস্থাটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও অযোগ্য এ প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিপিপির শর্ত ভঙ্গ করে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর ইচ্ছায় কিউসিবিএস পদ্ধতির পরিবর্তে সিঙ্গেল সোর্সি পদ্ধতিতে স্মেককে এক বছরের জন্য নতুন করে নিয়োগের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যা ডিপিপিতে উল্লেখ থাকা কিউসিবিএস এর পরিপন্থি। অথচ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেকর এখনকার কর্মরত অনভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে প্রকল্পের কাজ আদৌ সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।শী নি