জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক ছাত্রী দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমবিএ’র ওই ছাত্রী এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন।
লিখিত অভিযোগে ওই ছাত্রী বলেন, অত্যন্ত বেদনার সাথে জানাচ্ছি যে, আমার বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের অসাধু আমন্ত্রণে সাড়া না দেয়ায়, আমাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। আর এই কাজে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের একটি মামুলি ধারাকে পুঁজি করে আমাকে এমবিএ কোর্সের শেষ পরীক্ষাটিতে বসতে না দেয়ার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে রীতিমতো অপব্যবহার করা হচ্ছে। আর আমাদের সবার জন্য চরম লজ্জার বিষয় এই যে, এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন একজন শিক্ষক, যার অসাধু ইঙ্গিতে সাড়া না দেয়ার ‘অপরাধে’ বিবিএ-তে প্রথম শ্রেণী (জিপিএ-৩.৫৫) এবং এমবিএ-তে এখন পর্যন্ত জিপিএ-৩.৪৫ ধরে রেখেও এখন এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া থেকেই বঞ্চিত হতে যাচ্ছি। একজন সচেতন নাগরিক ও গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এ ধরনের ‘নিরব নারী নির্যাতন’ মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মঞ্জুরি কমিশনে লিখিত অভিযোগে ছাত্রী বলেন, আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অবিবাহিত এই ব্যক্তিটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-এমবিএ পড়ুয়া সুন্দরী ছাত্রীদের ফেইসবুক, ইয়াহু, স্কাইপ প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যমের চ্যাটিং-এ নানারকম বাজে ইঙ্গিত দেন। ছাত্রীরা পড়ালেখা-ক্যারিয়ার-রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে চাইলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি ইঙ্গিত দেওয়াতেই ব্যস্ত থাকেন। এটাকে তিনি ‘সোস্যাল মার্কেটিং’, ‘রিলেশনশিপ মার্কেটিং’ ইত্যাদি বলতেও পছন্দ করেন। আর, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে তাল না মেলালে সুযোগ বুঝে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভোগান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে ছাত্রীদের নাজেহাল করেন, নয়তো সামাজিক মাধ্যমের চ্যাটিং-এ নানা ধরনের আবেগপ্রবণ কথা অনবরত বলার মাধ্যমে চরম মানসিক পীড়ায় জর্জরিত করে তোলেন। ফেইসবুকে এই শিক্ষকের ওয়ালে তার নিজের শেয়ার করা কয়েকটি লিংক আর স্ট্যাটাস দেখলেই তার চরম হীন-কুরুচীপূর্ণ মানসিকতার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় (সিডিতে সেগুলোর স্ক্রিন শট দেয়া আছে)।
তিনি অভিযোগ করেছেন, ওই শিক্ষক বিবিএ পাঠরত অবস্থার এক পর্যায়ে আমাদের একটি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে ক্লাশ নেয়া শুরু করেন এবং নিজেই সব ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তার সঙ্গে ফেইসবুকে সংযুক্ত হয়ে পাঠদান প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও গতিশীল করার তাগাদা দেন। সেই প্রক্রিয়ায় আমিও ক্লাশের অন্যান্য সবার মতো তাকে ফেইসবুকে সংযুক্ত (ফ্রেন্ড) করি।
ছাত্রী মঞ্জুরি কমিশনে প্রেরিত অভিযোগপত্রে বলেন, এমন অবস্থায় গত ১২ নভেম্বর ২০১১ তারিখ রাত ১:৫২ মিনিটে আমাকে ওই স্যার প্রথমবারের মতো ফেইসবুক চ্যাটে নক করেন বা কথা বলার অনুরোধ জানান। সরাসরি-শিক্ষক হওয়ায় আমি গভীর রাতে হলেও এটিকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েই কথা বলি। এরপর নানা সময়ে নানা ভাবে অসংখ্যাবার বিভিন্ন অসাধু-বাজে-প্রেমময়-ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলে টানা নয় মাস আমাকে তার কাছে টানার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আমি নানা উপায়ে তার আহ্বান এড়িয়ে তথ্যনির্ভর আলাপের চেষ্টা করলেও তিনি তার পথ থেকে এক বিন্দু নড়েননি। অবশেষে নয় মাস পর গত ৫ আগস্ট ২০১২ তারিখ রাত ১০:৪৮ থেকে ১১:২৭ সময় পর্যন্ত ফেইসবুকে তিনি আমাকে বাড়াবাড়ি রকমের প্রেমময় ইঙ্গিত দিতে থাকলে, আমি এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে স্যারকে ফেইসবুক থেকে বাদ দেই বা আনফ্রেন্ড করি।
কিন্তু, বিবিএ এবং এমবিএ-প্রথম সেমিস্টার শেষ হবার পর, এমবিএ-দ্বিতীয় সেমিস্টারে স্যার আবারও একটি বিষয়ে পাঠদান করতে আসেন এবং তিনি নিজে শিক্ষার্থীদেরকে আগের মতোই ফেসবুকে তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে বলেন। ফলে, আনফ্রেন্ড করার ১৫ মাস পর গত ২৫ নভেম্বর ২০১৩ পুনরায় আমি তাকে সংযুক্তি-অনুরোধ বা অ্যাড-রিকোয়েস্ট পাঠাই।
অভিযোগে ওই ছাত্রী বলেন, স্যার রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করলেও, আগে কেন তাকে আনফ্রেন্ড করেছিলাম –সেটাকে ইস্যু করে আমাকে অনবরত প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকেন; আমি বারবার আমার ব্যাক্তিগত সমস্যার কথা বললেও তিনি তার তোয়াক্কা না করে আমাকে বিভিন্ন আবেগময়-প্রশ্নসম্বৃদ্ধ কথা বলার মাধ্যমে রীতিমতো মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকেন। এমনকি ‘কেউ আমাকে ভালো না বাসলে আমার কিছু করার নাই’ ইত্যাদি ধরনের প্রেমময় ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার ফুলঝুড়ি ছোটাতে থাকেন আগের মতোই। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে নিজেকে সুস্থ রাখার স্বার্থে আমি ফেইসবুক চ্যাট অপশনটি ব্যবহার করাই বন্ধ করে দেই।
তিনি বলেন, পেশাগত কারণে আমি স্বাভাবিকভাবেই কোন শিক্ষকের ক্লাসই পুরোপুরি করতে পারিনি, এমন সমস্যা আরও অনেকেরই আছে। ওই স্যার ছাড়া বাদবাকি শিক্ষকদের প্রত্যেকেই জগন্নাখ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে কর্মজীবী এমবিএ শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সহযোগী ভূমিকা পালন করলেও, জনাব জহীর উদ্দিন আরিফ স্যার আমার উপস্থিতি কিছুটা কম হওয়ায় (৪০%) এটিকে ইস্যু করে অতিরিক্ত কড়াকড়ি শুরু করেন। এমনকি, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক আমাকে ও আমার কয়েকজন সহপাঠীকে নিশ্চিত করেছেন যে, পরীক্ষা কমিটির বৈঠকে কর্মজীবী এমবিএ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির বিষয়টি প্রত্যেক শিক্ষক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে নিলেও, একমাত্র ওই স্যার বিশ্ববিদ্যালয় আইনের শিথিলযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত একটি ধারাকে প্রধান করে, বিষয়টি নিয়ে ওই বৈঠকে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন এবং বিষয়টি সিদ্ধান্তহীনভাবে রেখেই বৈঠক শেষ করতে বাধ্য করেন।
ছাত্রী বলেন, এর আগে তিনি আমার সঙ্গে ক্লাশ চলাকালীন সময়েই দুর্ব্যবহার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্লাসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর রোল-কল করলেও, আমার রোল-কল না করেই বেরিয়ে যান। আমি তার পিছে পিছে গেলে তিনি কোন কথাই না শুনে আমাকে দূর-দূর করে এই বলে তাড়িয়ে দেন, আর বলেন যে- ‘তোমার সাথে এখন কোন কথা নয়, কথা হবে পরের সেমিস্টারে’। এর মাধ্যমে তিনি আমাকে ফাইনাল পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করার প্রত্যক্ষ হুমকি দেন। শুধু তাই নয়, ক্লাসে আমার অনুপস্থিতিতে সবার সামনেই তিনি বলেছেন যে, কোন মতেই তিনি আমাকে এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে দেবেন না এবং আমি কিভাবে এমবিএ করি তা তিনি দেখে নেবেন। এর সত্যতা ক্লাশের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হতে পারবেন।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়, যাই হোক, স্যার তার সেই কথা অনুযায়ী সে পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। শুধুমাত্র তিনি বাধা দেয়ায় কর্মজীবী নারী ও গণমাধ্যমকর্মী হয়েও সব বাধা পেরিয়ে এ যাবৎ বিবিএ-এমবিএ দু’টোতেই প্রথম শ্রেনীর জিপিএ ধরে রেখেও আমি শেষ পরীক্ষাটি নিয়ে সংশয়ে আছি। অথচ, এর আগের সেমিস্টারে একই ব্যাচের ছাত্র এক শিবিরকর্মী পুরো সেমিস্টার জুড়ে কারাভোগ করায় ১০ শতাংশেরও কম উপস্থিতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছিলো। আর ৪০ শতাংশ উপস্থিতি নিয়েও কেবল একজন লম্পট শিক্ষকের লাম্পট্যের ডাকে সাড়া না দেয়ার অপরাধে কর্মজীবী নারী ও সাংবাদিক হয়েও আমি পরীক্ষা নিয়ে হুমকির মুখে পড়েছি।
ওই ছাত্রী বলেন, ইতিপূর্বে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি আমার বিভাগের চেয়ারম্যানকে জানানোর চেষ্টা করা হলেও, শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষকের সন্তান হিসেবে আরেকজন শিক্ষকের অপদস্থ হওয়া মেনে নিতে কষ্ট হওয়ায় আমি আমার পরিবারকে কিছুটা ছোট প্রতিপন্ন করেই স্যারের আজেবাজে কথাবার্তার বিষয়টি গোপন করি। কিন্তু এটি স্যারের কানে গেলে, আমার গোপন করে যাওয়াকে দুর্বলতা ধরে নিয়ে আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠেন। নিজের অপরাধ ঢাকতে তিনি সম্প্রতি নিজের ফেইসবুক পরিচয়ে নিজের প্রকৃত নামটি পর্যন্ত বদলে ফেলেছেন, আমাকে ব্লক করেছেন এবং আমাকে পরোক্ষভাবে বিভিন্ন হুমকি-ধামকিও দিয়ে চলেছেন। শুনেছি, তিনি নাকি আমাকে প্রকাশ্যে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার শর্তে পরীক্ষা দিতে দেবেন –এমন মন্তব্যও করেছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, এ অবস্থায় আমি রাষ্ট্র ও নারী সমাজের সার্বিক স্বার্থে ওই লম্পট শিক্ষককের যাবতীয় ফেইসবুক কথপোকথন পুরোপুরি প্রকাশ করার মাধ্যমে শিক্ষক পরিচয়ধারী মানসিকভাবে বিকৃত ও রোগাক্রান্ত একজনের প্রকৃত চরিত্র উন্মোচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কথপোকথনগুলোতে তার আপত্তিকর কথা ও ইঙ্গিতের অংশগুলো বাক্সবন্দী করে চিহ্নিত করা আছে।
ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, ওই স্যার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-এমবিএ পড়ুয়া বহু ছাত্রীকেই এভাবে নাজেহাল করেন বলে শোনা যায়। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যত দ্রুত সম্ভব ঝামেলামুক্তভাবে পড়ালেখা শেষ করার স্বার্থেই কেবল বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। আর এটাকেই দূর্বলতা ধরে নিয়ে দিন দিন আরও ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ করে চলেছেন এই লম্পট শিক্ষক। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে এবং একজন বাজে মানুষের অপরাধ-অপকর্মের ডাকে সাড়া না দেয়ায় আমার নিরবিচ্ছিন্ন ভালো ফলাফলপূর্ণ লেখাপড়ায় সম্ভাব্য ব্যাঘাত থেকে আমাকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে আপনার আশু পদক্ষেপ করজোরে মিনতি করছি।
উল্লেখ্য, অভিযোগকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত।