একেবারে মহারাজা স্টাইলে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে নিজের মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। যিনি এখন আরেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এই মন্ত্রী বিগত আমলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে গেছেন নিজের ইচ্ছামতো। যেন নিজের পৈতৃক সম্পত্তিই বিলিয়েছেন। সর্বশেষ তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী থাকাবস্থায় শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতিকে রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি নামমাত্র মূল্যে দলিল করে দিয়েছেন। এ ছাড়া বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমিসহ শিল্প কারখানা বিনা টেন্ডারে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি কেউ সাদা কাগজে আবেদন করলে তিনি সেই আবেদনকারীকে জমি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের পাঁচ বছরে মন্ত্রী প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ একাই বিক্রি করে দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে কুষ্টিয়ার মোহিনী টেক্সটাইল মিলস, চিশতী টেঙ্টাইল মিলস, মসলিন কটন মিল। খোদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাগজপত্রে এসব অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।
জমি দিতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি নোটের ৩৮৭ অনুচ্ছেদে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলকন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান উল্লেখযোগ্য। তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা একটি হাসপাতাল নির্মাণ- কিন্তু যুতসই ভূমির অভাবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।’ এ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে প্রতি বছর এক লাখ এক হাজার এক শত এক টাকা লিজমানি ধার্য করে (এক কোটি এক লাখ এক হাজার এক শত এক টাকা) ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ টাকা এককালীন এক পে অর্ডারে বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে জমা দিতে চট্টগ্রাম সমিতিকে বলেছেন। এ জন্য সমিতিকে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এ আদেশটি অবিলম্বে কার্যকরের কথাও নোটশিটে উল্লেখ করেন মন্ত্রী। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সমিতিকে দেওয়া ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মতিঝিল মৌজার হোল্ডিং নম্বর ১৭৬, আর এস দাগ নম্বর ২৪৫৮, ঢাকা সিটি জরিপের দাগ নম্বর ৩৩৩৯-এর অন্তর্ভুক্ত। এ জমিটি সমিতিকে দেওয়ার বিষয়ে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর নোটশিটে উল্লেখিত মন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পর জমির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয় বিজেএমসি বোর্ড ও কোম্পানি শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল মান্নানকে। ওই পত্রে জমির লিজ দলিলসংক্রান্ত কাগজপত্র, মামলা থাকলে তার কাগজপত্র ও মামলার হালনাগাদ অগ্রগতির তথ্যাদি এবং সি এস খতিয়ানের দাগ নম্বরসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর বিজেএমসি থেকে জানানো হয়- জমির লিজ দলিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এটি পূর্ব পাকিস্তান সরকার নিশাত জুট মিলের মালিক মিয়া আবদুল হামিদের অনুকূলে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করে। পরবর্তীতে জুট মিলটির মালিক পাকিস্তানি হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে মিলটিকে জাতীয়করণ করে বিজেএমসির মালিকানাধীন রাখে। সেই থেকে এটি বিজেএমসির দখলে রয়েছে। একই সঙ্গে সরকার মিলটি পাকিস্তানি মালিকানাধীন হওয়ায় পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘খ’ তফসিলে তালিকাভুক্ত করে। পরবর্তীতে এ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে জনৈক জাহানারা বেগম গং বাদী হয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব এবং বিজেএমসি চেয়ারম্যানকে আসামি করে মামলা করেন। এ মামলাটি এখনো চলমান।
ওই চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়- এ অবস্থায় চট্টগ্রাম সমিতির সঙ্গে লিজ চুক্তি সম্পাদনের আগে নিশাত জুট মিলের মালিকের সঙ্গে করা চুক্তিনামা এবং আদালতের দায়েরকৃত মামলার বিষয়টি বিবেচনায় রাখার দাবি রাখে। এর পর পরই বিষয়টি মন্ত্রীকে অবহিত করা হয়।
গত ৮ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের একটি পত্র থেকে জানা যায়, মন্ত্রীর নির্দেশে জমিটি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবের নামে মিউটেশন করার জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) মতিঝিল কার্যালয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে এবং দু-এক দিনের মধ্যে মিউটেশন হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অন্য এক চিঠিতে দেখা যায়, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জমিটির মিউটেশন সম্পন্ন করে ১২ জানুয়ারি এ জমিটি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি ট্রাস্টি বোর্ড চট্টগ্রাম ভবন, ৩২ তোপখানা রোড ঢাকার অনুকূলে রেজিস্ট্রি দলিল সম্পাদন করা হয়।
এদিকে নতুন সরকার গঠনের পর নামমাত্র মূল্যে চট্টগ্রাম সমিতিকে দেওয়া জমির অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এর পর পরই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে।
মসলিন কটন মিল বিক্রিতেও নয়ছয় : নয়ছয় করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে গাজীপুরের বিখ্যাত মসলিন কটন মিল। সরকারের সম্পত্তি বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব বিধিবিধান মানার কথা তার অনেক কিছুই মানা হয়নি। সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মূল্যায়ন না করিয়েই মিল বিক্রির উন্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অসঙ্গতি। পরিশোধ করা হয়নি মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা। এমনকি সরকার ও ক্রেতা পক্ষ এ বকেয়া পাওনার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও মিল বিক্রিতে বিলম্ব হবে এ আশঙ্কায় চুক্তিতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে কলকাঠি নেড়েছেন মূলত সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার সদয় হস্তক্ষেপে রিফাত গার্মেন্ট লিমিটেডের নামে মিলটি কেনার চুক্তি করেন এফবিসিসিআইর সাবেক এক সভাপতি। গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ এ মিলটি ১৯৫১ সালে ২৪০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত হয়। এতে আছে ৫২ হাজার স্পিন্ডল, ৪৯৮টি উইভিং ও ৪৯৬টি স্পিনিং তাঁত। প্রায় ২ হাজার ৮৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন শিফটে মিলে কাজ করতেন।
শ্রমিক-কর্মচারীদের মিল বেচে দিলেন মন্ত্রী : সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নিউ লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের শেয়ারের মালিকানা পেয়েছিলেন মিলটির শ্রমিক-কর্মচারীরা। এমনকি চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের নামে দেওয়া ওই শেয়ার হস্তান্তরেও রয়েছে বিধিনিষেধ। তার পরও পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ওই মিলটি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন।
পানির দরে চিশতী টেক্সটাইল : পানির দরে বিক্রি করে দেওয়া হয় কুমিল্লার দৌলতপুরের ঐতিহ্যবাহী চিশতী টেক্সটাইল। কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই ১৬ দশমিক ৬৬ একর জমির ওপর স্থাপিত মিলটি মাত্র ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। এলাকাবাসীর মতে ওই জায়গার সর্বনিম্ন দাম ধরেও মিলটির বিক্রয়মূল্য ১৫০ কোটি টাকার বেশি হতো।
এদিকে কুষ্টিয়া শহরে অবস্থিত মোহিনী টেক্সটাইল মিলটিও নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ১৯০৮ সালে এ মিলটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বস্ত্রকল হিসেবে ১০০ একর জমির ওপর স্থাপন করেছিলেন মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী। বা প্র