ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গত তিন মাসে অন্তত পাঁচটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শুক্রবারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর আগে একটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি করেছে। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন ও ছাত্রলীগের উচ্চপর্যায়ের চাপের মুখে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
গত শুক্রবার অপহরণের মুক্তিপণ আদায় করতে গিয়ে ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাসহ সাতজনকে আটক করা হয়। এঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে কি না, তা নিয়ে পুলিশও বিভ্রান্ত ছিল। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এঁদের ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। তবে তাঁদের একজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ ছাড়া চারজনকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে চলতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি অপহরণের ঘটনা ঘটল। আর ফেব্র“য়ারিতে ঘটেছে তিনটি। অনুসন্ধানে জানা যায়, সব ঘটনাতেই ‘পাওনা টাকা উদ্ধারে’র বিষয়টি জড়িত। এ ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় কাজ করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। এরা অবশ্য এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে না।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান বলেন, ‘অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে টাকাপয়সা উদ্ধার করে দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু অপহরণের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো নেতার জড়িত থাকার কথা আগে কখনো শুনিনি। শুক্রবারের ঘটনা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ এর আগেও এক কর্মীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। তবে কোন ঘটনা, সেটা বলতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা থেমে নেই। আমাদের নজরে পড়লে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিই। কিন্তু আমার মনে হয়, অসৎ সঙ্গে পড়ে অনেকে এসব কাজে জড়িয়ে যায়। এদের এক বছর-ছয় মাস বহিষ্কার কোনো সাজাই নয়। তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে হবে।’
আগের ঘটনা: গত ১৩ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের একতলা থেকে (২১৯ নম্বর কক্ষের জানালা দিয়ে) লাফিয়ে পড়ে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া তরিকুল ইসলাম (অর্ক)। তাঁর পেছন পেছন লাফিয়ে পড়েন হলের ছাত্রলীগ কর্মী আরিফুর রহমান (লিয়ন)।
ঘটনার পরপরই হল কর্তৃপক্ষ কক্ষটি সিলগালা করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৭ ফেব্র“য়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ও প্রক্টর অফিসের একটি সূত্র জানায়, তরিকুলের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য তাঁকে নিজ কক্ষে আটকে নির্যাতন করছিলেন ফিন্যান্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফুর। দুজনের বাড়িই বগুড়ায়। তাঁরা পূর্বপরিচিত।
এ ছাড়া নিচতলার দুটি কক্ষের বাসিন্দারা জানান, লাফিয়ে পড়ে ‘আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে’ এবং ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন তরিকুল। হলের একাধিক কর্মচারী জানান, চিৎকার শুনে তাঁরা গিয়ে দেখেন, আরিফুর ওই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আছেন।
অপহরণের এ ঘটনা নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন। তাঁরা জানান, শুধু আরিফুরই নন, ছাত্রলীগের হল শাখার একটি অংশ এতে জড়িত।
জানতে চাইলে গতকাল শনিবার তদন্ত কমিটির প্রধান পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আমিনুল হক বলেন, ওরা পারিবারিকভাবে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেছে।
গত ১২ ফেব্র“য়ারি রাতে ছাত্রলীগের স্যার এফ রহমান হলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হাফিজ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস রিফাতকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাত দেড়টার দিকে তাঁরা দুজন নীলক্ষেতের একটি বিকাশ এজেন্টের দোকান থেকে দুই লাখ টাকা তুলতে যান। এঁদের ধরার পর হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় এক ব্যক্তিকে। তাঁদের তিনজনকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, হল থেকে উদ্ধার হওয়া ওই ব্যক্তিকে আটকে রেখে টাকা চাওয়া হয়েছিল। পরে টাকা দেওয়ার ফাঁদ পেতে নীলক্ষেত থেকে হাতেনাতে আটক করা হয় তাঁদের।
হল শাখা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, সহসভাপতি নয়নের এক পরিচিত ব্যক্তি অপহূত ওই ব্যক্তির কাছে দুই লাখ টাকা পেতেন। সেই টাকা উদ্ধারে নয়ন দুই সহযোগীকে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে আসেন। পরে তাঁর পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হয়। চুক্তি ছিল, টাকা উদ্ধার করে দিতে পারলে কমিশন পাবেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নয়ন বলেন, ‘ঘটনা আপনি যতটুকু শুনেছেন, সেটাই। তবে আমরা কোনো অন্যায় করিনি। একজন টাকা পেতেন, তা উদ্ধার করে দিয়েছি। ডিবি পুলিশ দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও ঘটনার সত্যতা জেনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।’
কমিশনের আশায় চুরির টাকা উদ্ধার করতে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গত ২৮ ফেব্র“য়ারি রাতে এক যুবককে তুলে নিয়ে আসেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল আলম। প্রক্টর অফিস ও হল সূত্রে জানা যায়, প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের এক দোকানদারের ৮০ হাজার টাকা চুরি হয়। চুরির টাকা উদ্ধার করার দায়িত্ব নেন মাহাবুবুল ও তাঁর সঙ্গীরা। রাতভর নির্যাতনের পর সকালে আহত অবস্থায় ওই যুবককে নিউমার্কেট থানার পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের উপস্থিতিতে মীমাংসা করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কেউ কোনো অভিযোগ না করলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। তাঁরা নিজেরা সমঝোতা করে নিয়েছেন।’
অভিযোগ আছে, ৬ মে রাত ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র এ বি মাইনুল ইসলামকে চানখাঁরপুল থেকে অপহরণ করেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক সোহেল রানা। ইন্টারন্যাশনাল হলের ৩১৬ নম্বর কক্ষে তাঁকে আটকে রাখা হয়। পরদিন টাকা দেওয়ার কথা বলে বের হয়ে
তিনি শাহবাগ থানায় মামলা করতে আসেন। কিন্তু ছাত্রলীগ জড়িত থাকায় মামলা না নিয়ে সমঝোতা করে নিতে বলে পুলিশ।
মাইনুল হাসান ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাঁকে আটকে রেখে তিন লাখ টাকা দাবি করেছিলেন সোহেল। গতকাল সোহেলের মুঠোফোন সকাল থেকেই বন্ধ পাওয়া যায়। আর মাইনুল কোনো কথা বলতে রাজি হননি। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সমঝোতা হয়ে গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন বলেন, এ ধরনের ঘটনা যে-ই ঘটাক, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রেপ্তার ৬, রিমান্ডে ১: গত শুক্রবারের অপহরণের ঘটনায় আটক সাতজনের মধ্যে ছাত্রলীগের এক নেতাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রলীগের ঊর্ধ্বতন এক নেতার চাপে পুলিশ ওই নেতাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অন্য ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মীকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনই করা হয়নি। শুধু আরফান পাটোয়ারি নামের একজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এ অপহরণের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এঁদের সাময়িকভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে ফরহাদ ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়। তাঁকে আটকে রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি কক্ষে। এরপর পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি পুলিশকে জানান। পুলিশ কৌশলে শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে সাতজনকে আটক ও অপহূত ফরহাদকে উদ্ধার করে।
আটক সাতজন হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপক্রীড়া সম্পাদক সৃজন ঘোষ ওরফে সজীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সহসভাপতি তানভীরুল ইসলাম, জগন্নাথ হল কমিটির সহসভাপতি অনুপম চন্দ্র, মুহসীন হল কমিটির ছাত্রবৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, ছাত্রলীগের কর্মী হিমেল ও ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী বাপ্পী। এঁদের সঙ্গে আরফান পাটোয়ারি নামের আরেক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে।
এ ঘটনায় ফরহাদের বাবা তাজুল ইসলাম শাহবাগ থানায় মামলা করেন। গতকাল তানভীরুলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত এঁদের গ্রেপ্তার করা না-করা নিয়ে পুলিশের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
অভিযোগ উঠেছে, তানভীরুল ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার ঘনিষ্ঠ। ওই নেতার তদবিরে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি বলেন, ‘কয়জনকে আটক করা হয়েছিল, তা আমি জানি না। তবে কাকে কেন ছাড়া হয়েছে, তা আমি খতিয়ে দেখছি।’
তানভীরুলকে ছাড়ার ব্যাপারে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, কারও ছাড়ার ব্যাপারে পুলিশের ওপর কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর বলেন, আটক হওয়া কয়েকজন তানভীরুলের এলাকার। তাঁদের ছাড়াতে তানভীরুল থানায় ছুটে গিয়েছিলেন।
রিমান্ডে আরফান: গতকাল বিকেলে গ্রেপ্তার ছয়জনকে মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তীর আদালতে হাজির করা হয়। আরফানকে পাঁচ দিনের রিমান্ড ও অন্যদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করে পুলিশ। আদালত আরফানকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে অন্যদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মীর রিমান্ড চাওয়া হয়নি কেন—জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, আরফানই মূল পরিকল্পনাকারী। তাই তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার ব্যাপারে অধিকতর তথ্য নেওয়া হবে। পরে প্রয়োজন হলে অন্যদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হবে।
সংশোধনী: গতকালের প্রতিবেদনে ভুলবশত লেখা হয়েছে, বাপ্পী ছাত্রলীগের জসীমউদ্দীন হলের সাবেক সহসম্পাদক। পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাপ্পী ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী। প্রআ