কালো পোশাকের মানুষদের নিয়ে কিছু কথা

1335189298-bangladesh-national-party-continues-strike-due-to-alleged-abduction_1171382-300x199নারায়ণগঞ্জের নৃশংস সেভেন মার্ডারের ঘটনাটি নিয়ে যদি এত আলোচনা ও সমালোচনা না হত তবে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য র‌্যাবের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসত না। মূল ঘটনাগুলো তখন অন্তরালেই থেকে যেত।
র‌্যাব গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে অস্পষ্ট কিছু প্রশ্নের খোলাখুলি উত্তর জেনে রাখা ভাল। কিছু প্রশ্ন উঠেছে যেমন কেন র‌্যাব গঠন করা হয়েছে? কারা র‌্যাব গঠন করেছিলেন? র‌্যাবের কর্তাদের ক্ষমতা কত? র‌্যাবের আসল কাজ ও দায়িত্ব কি কি? র‌্যাব কি আসলেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে আদৌ পেরেছে কি না? তবে এটি সত্য যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কিন্তু একটি সংগঠিত এলিট বাহিনী দরকার। তবে আরও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। তাহলে চলুন দেখি প্রশ্নগুলোর বিপরীতে কি কি উত্তর দাঁড় করানো যায়।
পুলিশের ক্রমাগত অনিয়ম ও দুর্বলতার কারণে মূলত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড রুখে দেওয়ার জন্যই র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি এবং আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। প্রথম দিকে র‌্যাব জঙ্গী বিরোধী অভিযান, মাদক চোরাচালন বন্ধ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং কুখ্যাত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তবে প্রশ্ন উঠেছে যদি পুলিশ র‌্যাবের মত কাজ করতে পারত তবে হয়তো র‌্যাব গঠনের কোনো প্রয়োজনই হত না।
র‌্যাবের কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে বিশেষ করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাজের জন্য র‌্যাব পেশাদারী মনোভাব দেখিয়েছে। সব কিছুই ঠিক চলছিল তবে সরকারের কিছু অহেতুক নির্দেশনার জন্য বাহিনীটির প্রতি আজ সমালোচনার তীর ছোঁড়া হচ্ছে। বিশেষ করে টি-২০ বিশ্বকাপের ম্যাচ টিকিট কালোবাজারী নিয়ন্ত্রণের মত অহেতুক কাজের দায়িত্ব দিয়ে বাহিনীর আত্মমর্যাদা এবং পেশাদারী মনোভাবে আঘাত করা হয়েছে। সরকারের কিছু অবিচক্ষণতামূলক সিদ্ধান্তের কারণে বাহিনীটিকে দিয়ে সকল ধরনের বিশেষায়িত এবং অবিশেষায়িত অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে। বিশেষ করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে বিচার বহির্ভূতহত্যাকাণ্ডের জন্য বাহিনীটিকে বিশেষ কৌশলের সাথে ব্যবহার করেছে সরকার। দেশি ও বিদেশি সমালোচনার পরেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র‌্যাবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বরং র‌্যাবের পক্ষে সাফাই গেয়েছে সরকার।
র‌্যাব গঠনের বিষয়ে যে কিছু কৌশলগত দিক রয়েছে যা নিয়ে কিন্তু কখনোই কথা বলা হয়নি। র‌্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়ানের প্রেক্ষিতে ক্ষেত্র বিশেষে ৪৫ জন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ৮ থেকে ১০ জন পুরো ব্যাটালিয়ানকে পরিচালনা করেন। সুতরাং প্রতি ব্যাটালিয়ানের জন্য যদি ১০ জন করে হিসেব করা হয় তবে পুরো ব্যাটালিয়ানের ১৪০ জন কর্মকর্তা পাওয়া যাবে, অথচ যেখানে ৬৩০ জন কর্মকর্তার প্রয়োজন ছিল। ধরুন যে বাহিনীতে প্রায় ৭ শ’ সদস্য রয়েছেন, তাদের পরিচালনা করার জন্য মাত্র এক চতুর্থাংশ কর্মকর্তা রয়েছেন। যেহেতু নির্দেশনা দেওয়ার মত পর্যাপ্ত কর্মকর্তা নেই তাই স্বাভাবিকভাবে বাহিনীর কার্যক্রম শতভাগ অর্জিত হবে না। এত কিছুর পরও র‌্যাবের পরিচালনা ও গঠন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো কিন্ত কখনোই সামনে আসেনি।
প্রশ্ন উঠতে পারে যদি কর্মকর্তাদের এতই অভাব থাকে তবে র‌্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়ান কোনো তৈরি করা হল? কর্মকর্তা কম থাকলে কি করে সুষ্ঠভাবে র‌্যাবের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব? প্রশ্ন উঠতে পারে যে র‌্যাব ভাল কাজ করছে কি না? অথবা র‌্যাবের কার্যক্রম দেখাশুনা করেন কারা?
তথ্য বলছে ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের পর বিভিন্ন অনিয়ম ও বিশৃংখলার কারণে বাহিনীটির প্রায় ২ হাজার সদস্যকে বিভিন্ন রকমের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ২ হাজারের মধ্যে আবার ৭ শ’ সদস্যকে গুরুতর শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং বাকিদের লঘু শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কার্যক্রম চালু করার পর থেকে বাহিনীটির বিরুদ্ধে ৪ হাজার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই করে ৭৮ জন র‌্যাব সদস্যকে জেল দেওয়া হয়েছে এবং ৭৬ জনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। ১৫ হাজার সদস্যের বাহিনীর এমন অপরাধের সংখ্যা কম মনে হতে পারে তবে যেহেতু বাহিনীটি এলিট শ্রেণীর তাই অপরাধ কম হলেও পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাহিনীটির সদস্যদের কৃত অপরাধ ও শাস্তির পরিসংখ্যন করলে হয়তো হতাশই হতে হবে।
র‌্যাবের পুনঃবিন্যাস ও পুনর্গঠনের বিষয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত আলোচনা প্রয়োজন। র‌্যাবের অর্জনকে অবশ্যই ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই তবে বাহিনীটির বিরুদ্ধে আনিত ৭৮৬টি বিচার বহির্ভূতহত্যাকাণ্ডেরও তদন্ত ও বিচারের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে।
অতীতে দেশের বিভিন্ন সংকটময় মূহুর্তে র‌্যাবের বিশেষ অবদানের কথা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। র‌্যাব এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে, বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে এবং ৫ শ’র বেশি ভয়ংকর, দাগি আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। আর যদি সরকার র‌্যাব পুনর্গঠনের বিষয়ে মাথা না ঘামাতে চায় তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাস নির্মূল করার প্রত্যয়ে নতুন ও আধুনিক একটি সমৃদ্ধশালী বাহিনী গঠনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। তবে বলতে ভয় নেই যে র‌্যাবকে অবশ্যই বিচার বহির্ভূতহত্যাকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে।
গত এক দশকের সুনাম, অর্জন এবং বিতর্কের পাশাপাশি র‌্যাবের কার্যক্রম আরও উন্নত এবং স্বাধীন করার জন্য সরকারকে আরও জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো দূর করে বাহিনীটি একটি পেশাদার বাহিনীতে রূপান্তর করতে হবে। র‌্যাবের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি দিতে হবে, বাহিনীটির দায়িত্ব নির্দিষ্ট করতে হবে, পাশাপাশি প্রতিটি ঘটনার জন্য বাহিনীকে জবাবদিহিতার সম্মুখিন করতে হবে।
প্রতিটি আইনশৃংখলা বাহিনীর কাজের সাফল্য এবং অর্জন নির্ভর করে কার তত্ত্ববধানে বাহিনীটি কাজ করছে তার উপর, অথবা কারা বাহিনীটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের উপর। এছাড়া বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের সততা এবং কর্মনিষ্ঠার উপর বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা, সফলতা এবং অর্জন নির্ভর করে। তবে যারা প্রতিটি বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন তারা যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হন তবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিটি বাহিনীর সদস্যরাও প্রভাবিত হন এবং প্রভুদের খুশি করার জন্য সকল ধরনের অনৈতিক কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেন না বাহিনীর সদস্যরা।
এটি সত্য যে হাতেগোনা কিছু সদস্যদের কারণে একটি বাহিনীকে বিলুপ্ত করা সমীচিন হবে না। যারা অপরাধ করেছেন তাদের সময়োপযোগি শাস্তি দিতে হবে। সত্যি বলতে র‌্যাবের দুর্বলতা এবং সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে বাহিনীটি হয়তো হারানো সুনাম অর্জন করতে পারবে এবং পুরোদমে পেশাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হতে পারবে।
ডেইলি স্টার থেকে অনুবাদ করেছেন জুলকারনাইন জ্যাকি – আমাদের সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *