স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য নির্মিত সরকারি ফ্ল্যাটের দাম বাজারছাড়া হওয়ায় জামানতের টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়ার পরও অনেকে টাকা তুলে নিয়েছেন; অনেকে তোলার জন্য আবেদন করেছেন। আবার নতুন যেসব প্রকল্পে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন আহ্বান করা হচ্ছে, সেগুলোতে তেমন সাড়া মিলছে না। তিন-চারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা মূল্য বেশি দেখিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কারণে সরকারি জায়গায় নির্মিত এসব ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি ধরা হয়েছে। অথচ ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য যেসব ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর দাম তুলনামূলক অনেক কম।
স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ মিরপুর-১৩ নম্বর এলাকায় স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পে ১১০০ বর্গফুটের যেসব ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে, প্রথমে এর মূল্য ধরা হয় ৭৩ লাখ টাকা করে। পরে কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তার চাপে তা পাঁচ লাখ টাকা কমিয়ে এখন ৬৮ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনে আমাদের জমির মূল্য ১২ লাখ টাকা কাঠা। সেখানে ওই মাপের ফ্ল্যাট তৈরিতে সর্ব্বোচ ৩৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। কারণ বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে ৪০ লাখ টাকা কাঠা করে জমি কিনে একই মাপের ফ্ল্যাট বিক্রি করছে ৪০ থেকে ৪২ লাখ টাকায়। সেখানে আমাদের ফ্ল্যাট ৬৮ লাখ টাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাই এখন এ প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া লোকজন জামানতের টাকা ফেরত নিচ্ছেন।’ আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিরপুর-২ নম্বর সেকশনে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যালয়ের পাশে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৩৬০টি ফ্ল্যাট বানানো হয়েছে। ১৩৩৬ বর্গফুটের একেকটি ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা। আবার লালমাটিয়ায়ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ১৪ তলার দুটি ভবনে ১০৪টি ফ্ল্যাটের প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৫৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। অথচ রাজধানীর অনুন্নত এলাকায় ১১০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টাকা।
রাজধানীর লালমাটিয়ায় ১৪ তলাবিশিষ্ট দুটি ভবনের নিচ তলায় কার পার্কিংসহ ১২৫০ বর্গফুটের ১০৪টি এবং ১০৬০ বর্গফুটের ৭৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০০৭ সালে। এ প্রকল্পে প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৬১ লাখ ৪ হাজার টাকা।
মিরপুরের ১৫ নম্বর সেকশনে আনন্দনগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায় ২০০৯ সালের শেষ দিকে। এ প্রকল্পের প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টাকা। অথচ বাজারদর অনুযায়ী দাম ৩৫ লাখ টাকার আশপাশে হবে বলে জানা যায়। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরায় সীমিত আয়ের মানুষের জন্য ১৫ তলাবিশিষ্ট কয়েকটি ভবনে ২১৬টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয় ২০১০ সালের শেষ দিকে। এ প্রকল্পে প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অভিজ্ঞদের মতে, এ ফ্ল্যাটের দাম হতে পারে ৩০ লাখ টাকা।
রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ায় সীমিত আয়ের লোকজনের জন্য ছয়টি ১০ তলা ভবনে প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৬৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা ৪৫ লাখ টাকার বেশি হওয়া অযৌক্তিক বলে স্থানীয়দের মত।
সিলেট শাহজালাল হাউজিং এস্টেটে সীমিত আয়ের লোকজনের জন্য তিনটি ভবনে একেকটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সংশ্লিষ্টদের মতে যা হতে পারে ৩৫ লাখ টাকা।
বগুড়া হাউজিং এস্টেটে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য তিনটি ১০ তলা ভবনে ১৩৫টি ফ্ল্যাট বানিয়ে প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের মতে, এসব ফ্ল্যাটের দাম হবে সর্বোচ্চ ৩২ লাখ টাকা করে।
এ ব্যাপারে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) শহিদুল্লাহ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পে সবুজায়ন বেশি রাখা হয় বলে ফ্ল্যাটের দাম একটু বেশি পড়ে। তবে যেসব ফ্ল্যাটের দাম অযৌক্তিক মনে হচ্ছে, তা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, রাজউকের ফ্ল্যাটে আগে যেখানে বিপুল প্রতিযোগিতা হতো সেখানে এখন বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আবেদনকারীই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হলো ফ্ল্যাটের দাম অযৌক্তিকভাবে নির্ধারণ।
জানা গেছে, সরকারি ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে প্রায় প্রতিদিনই গ্রাহকরা টাকা তুলে নিচ্ছেন। রাজউক থেকে এ পর্যন্ত ৫২৩ জন আবেদনকারী তাঁদের জামানতের টাকা তুলে নিয়েছেন। আর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চলমান চারটি ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে শতাধিক ব্যক্তি জামানতের টাকা তুলে নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিদিনই কেউ না কেউ টাকা তুলে নেওয়ার জন্য আবেদন করছেন বলে প্রকল্প সূত্রে জানা যায়।