সিনেমায় নায়ক মানেই- একাই একশ। বিপক্ষে যতজনই থাকুক না কেন তার সঙ্গে পেরে ওঠেনা কেউই। শুধু তাই নয়, বহুতল ভবনের উপর থেকে লাফ দিয়েও বেঁচে থাকেন নায়ক (এখনকার দিনে নায়িকাও) বা শক্তিশালী ভিলেন।
ছবিতে দেখা আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটে বা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁচের দেয়াল ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে নায়িকাকে উদ্ধার করার ভয়াবহ ঝুঁকির কাজগুলো বাস্তবে নায়ক করেন না। এমনকি পর্দায় নায়কের হাতে চরম ধোলাই খেয়ে পাহাড় থেকে ভিলেনকে পড়ে যেতে দেখা গেলেও বাস্তবে সেই লাফ ভিলেন দেন না। এসব কাজে তাদের ডামি ব্যবহার করা হয়। আর যারা এই কাজটি করেন, শুটিং ইউনিটে তারা ‘স্টান্টম্যান’ বা ‘ডামিম্যান’ নামে পরিচিত।
বর্তমানে নিয়মিতভাবে এফডিসিতে এই কাজটি করছেন সাতজন। এর বাইরেও অনিয়মিত অনেকে আছেন। তারা সবাই সিনেমায় কাজ করা বিভিন্ন ’ফাইটিং গ্রুপের’ হয়ে কাজ করেন। এর মধ্যে আরমান ফাইটিং গ্রুপে ২ জন, আপন-ভাতিজা গ্রুপে ২ জন এবং সালাম ফাইটিং গ্রুপে আছেন ২ জন। এছাড়া এককভাবে কাজ করছেন মিঠু নামের এক ডামিম্যান।
নিজ
পেশা সম্পর্কে মিঠু বলেন, ”সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকেই কাজটা করি। আর এটাতো এখন আমাদের ব্যবসা। যার লাভ-ক্ষতিও আছে”।
খবর নিয়ে জানা গেছে, যেকোনো ছবির অ্যাকশন দৃশ্যে কাজ করলে একজন ‘স্টান্টম্যান’ পান ১ হাজার ছয়শ টাকা। সঙ্গে ডামির কাজ করলে যোগ হয় দুই হাজার টাকা। ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন কাজ করার পর ৩ হাজার দুইশ টাকা পান এই স্টান্টম্যানরা। আবার প্রতিদিন কাজও থাকে না।
এমনও হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে আড়ালে চলে গেছেন। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লাখ-কোটি দর্শককে আনন্দ দিতে গিয়ে তাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে উল্টো নিজের পরিবারেরই বোঝা হয়ে পড়েন। সেই খবর রাখেন না তারা যাদের হয়ে কাজ করেন সেই নায়ক বা খ্যাতিমান ভিলেন কিংবা কাড়ি কাড়ি টাকা ঘরে তোলা প্রযোজক-পরিচালক। হলিউড-বলিউডে এই বাস্তবতা অতটা নির্মম না হলেও বাংলাদেশে এটাই সত্য।
এফডিসিকেন্দ্রিক একাধিক অ্যাকশন আর্টিস্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো অঘটন ঘটলে পরিচালক প্রযোজকরা প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও মূল দায়িত্বটা আহত স্টান্টম্যানের নিজের কাঁধেই রাখতে হয়।
এদিকে পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী সমিতি থাকলেও স্টান্টম্যানদের কোনো সংগঠন নেই। জানতে চাইলে এক স্টান্টম্যান বলেন, “এফডিসিতে ফাইটারদের জন্য একটা সংগঠন আছে। ভাই ভাই সমিতি। এটি গঠন করে গিয়েছিলেন প্রয়াত নায়ক জসিম। আর ‘স্টান্টম্যান’-এর সংখ্যা কম হওয়াতে কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি।”
ঢাকাই সিনেমার শুরু থেকেই ডামির ব্যবহারের সূচনা।‘উৎসর্গ’ ছবিতে প্রথম অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত হয়। আর দেশের প্রথম অ্যাকশন গ্রুপের নাম ‘জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ’। এর পুরোধা ছিলেন ভিলেন থেকে পরে জনপ্রিয় নায়কে পরিণত হওয়া জসিম। এই গ্রুপটি সংক্ষেপে ’জ্যাম্বস গ্রুপ’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিল। পরে নায়ক জসিমের মৃত্যুর পর ভেঙ্গে যায় এই গ্রুপটিও।
স্ট্যান্টম্যানদের কাজ নিয়ে পরিচালক কাজী হায়াত বলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাবেই তাদেরকে এত ঝুঁকি নিতে হয়। তারা আহত হলে আমরা আমাদের সাধ্যমত সাহায্য করতে চেষ্টা করি। কিন্তু যেটা করি সেটা দিয়ে তাদের আসলে তেমন কিছুই হয় না। সাময়িক চিকিৎসা দেওয়া যায় মাত্র।
তিনি আরও বলেন, “এক্ষেত্রে আমি অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকেই দায়ী করবো। কারণ পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যয়ভার নিতে গেলে আর সিনেমা বানানো সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
প্রযোজক সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এ জে রানা বলেন, ”একজন স্ট্যান্টম্যান মূলত একজন নায়ককেই হিরো হিসেবে গড়ে তোলে। কিন্তু একজন স্ট্যান্টম্যান আহত হলে সেই নায়ক বা নায়িকারা এগিয়ে আসেন না। আমি মনে করি তাদের সাহায্যে আমরা যেমন আছি তেমনি শিল্পীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।”
বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদনের সূত্রে খোঁজ করা হয় দেশি স্ট্যান্টম্যানদের দুর্দান্ত কোনও ঝুঁকিপূর্ণ স্ট্যান্টদৃশ্যের। ধারণা করা গিয়েছিল বেশ কিছু অসাধারণ পিলে চমকানো দুঃসাহসিক ছবি পাঠকদের উপহার দেওয়া যাবে। কিন্তু হায়। এ ধরনের তেমন কোনও ছবিই আমরা খুঁজে পাইনি।
খোঁজ খবরে জানা যায়, নায়ক-নায়িকা বা জনপ্রিয় ভিলেন-ভক্ত দর্শকের সামনে ওইসব শিল্পীদের মান বাঁচাতে স্টান্টম্যানদের কোনও স্টান্টদৃশ্যের ছবি তোলা হয় না। এটা এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। কারণ দর্শকের সামনে ওই ছবি চলে গেলে হটকেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দর পড়ে যেতে পারে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এফডিসির একজন কর্মী বলেন, “আসল ঘটনা অন্য জায়গায়। বিদেশে এসব নিয়া এত লুকাছাপা নাই। কারণ সেখানে এ ধরনের দৃশ্যে ব্যাপক সাবধানতা নেওয়া হয়। আছে ইন্সু্রেন্সের ব্যবস্থাও। কিন্তু আমাদের এখানে এসব কিছুই নেই। তাই কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে সেসময়ের তুলে রাখা কোনও ছবি প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা না যায়- তাই এই কায়দা। কারণ, এটা হলে প্রযোজক-পরিচালককে মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হবে।
আর তাই, মাত্র হাজার দুয়েক টাকার জন্য আমাদের দুঃসাহসী স্টান্টম্যানরা জীবন বাজি রেখে একের পর এক নিয়ে যাচ্ছেন ভয়াবহ সব ঝুঁকি। নাম-যশ-অর্থ-খ্যাতি সব হচ্ছে নায়ক-নায়িকা-ভিলেনরা। স্টান্টম্যানরা থেকে যাচ্ছেন তাদের মতোই।