ডেস্ক রিপোট : তখনও আলোচনায় আসেননি নূর হোসেন। একটু একটু করে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। গুরু শামীম ওসমানকে আড়ালে রেখে তিনি আরও উপরের দিকে যোগাযোগ শুরু করেছেন। তারই এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে যান। এরই প্রমাণ মেলে ২০০৯ সালে এইচটি ইমামের পক্ষ থেকে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বরাবর লেখা একটি চিঠিতে। নূর হোসেনকে নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য “বিশেষ অনুরোধ” জানিয়ে “অতি জরুরি” চিঠিটি লেখেন এইচটি ইমাম। ২০০৯ সালের ৮ জুন লেখা ওই চিঠিতে তিনি তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বরাবর সিদ্ধিরগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত নূর হোসেনকে নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য “বিশেষ অনুরোধ” জানিয়ে “অতি জরুরি” চিঠিটি (স্মারক নং : সম/উপদেষ্টা/০১/২০০৯-১৯) পাঠিয়েছিলেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, আলোচিত সেই চিঠির পর থেকেই সিদ্ধিরগঞ্জের একক অধিপতি হয়ে উঠতে থাকেন নূর হোসেন। যদিও তৎকালীন স্থানীয় এমপি কায়সার হাসনাতের প্রচ- বিরোধিতার কারণে নূর হোসেনকে পৌর প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়নি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, এইচটি ইমাম বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চিঠিটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা তার চিঠিতে নূর হোসেনকে তিনটি জায়গায় ‘আওয়ামী লীগ’ নেতা লিখেছেন। একটি জায়গায় এইচটি ইমাম তাকে (নূর হোসেনকে) ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে এইচটি ইমামের কাছে মন্তব্য জানার চেষ্টা করলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর তার ব্যক্তিগত সহকারী কমল কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উপদেষ্টা মহোদয়ের বাসার টেলিফোন নাম্বার দেন। ওই নাম্বারে বুধবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। উনার বাসার ফোন রিসিভকারী মোহাম্মদ কবীর হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্যার মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। পরে ফোন করেন।’ একাধিকবার ফোন করলেও কবির হোসেন একই কথা জানান।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এমপি কায়সার হাসনাত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ওই চিঠিটির কথা শুনে আমাদের দলের (আওয়ামী লীগের) সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে আপত্তি জানিয়েছিলাম।’
কি আপত্তি জানিয়েছিলেন? জবাবে সাবেক এই এমপি বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাবাসীর দাবির মুখে আমি মন্ত্রীকে বলেছিলাম নূর হোসেনকে যেন পৌর প্রশাসক না বানানো হয়।’
সেই চিঠি ৃ
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো সেই চিঠির ‘বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, ‘বিধি বহির্ভূতভাবে অপসারিত পূর্বতন সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভায় পৌর প্রশাসক পদে নিয়োগ।’
চিঠির মূল অংশে এইচটি ইমাম উল্লেখ করেছেন, ‘আবেদনকারী (নূর হোসেন) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল সম্পূর্ণ বে আইনীভাবে তাকে চেয়ারম্যানের পদ হতে অপসারণ করে। এরপর তার উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। তিনি যাতে আইনের আশ্রয় নিতে না পারেন সেজন্য তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে ও বাসগৃহে হামলা চালানো হয় এবং তার পিতার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি। ২০০৫ সালের ১৩ আগস্ট তারিখে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মতিন প্রধানকে চেয়ারম্যান করে ১২ জন বিএনপি নেতার সমন্বয়ে একটি পৌর কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়, যে কমিটি নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা অদ্যাবধি পরিচালনা করছে। ওই আব্দুল মতিন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দুর্নীতিতে সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার সকল কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। উপরন্তু আব্দুল মতিন তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বলে আবেদনে (নূর হোসেনের) জানা যায়। বর্তমানেও পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে তার দহরম-মহরম আছে বলে সে প্রচার করে এবং আওয়ামী লীগ নেতা পূর্বতন ইউপি চেয়ারম্যান মো. নূর হোসেনকে আবার ক্রসফায়ারে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও তার দাপট বিন্দুমাত্র কমেনি।
এমতাবস্থায় ওই সন্ত্রাসী বিএনপি নেতা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সমন্বয়ে গঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার ১২ সদস্যের কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মো. নূর হোসেনকে সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার পৌর-প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’
প্রধামন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের প্যাডে পাঠানো ওই চিঠিটির অনুলিপি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র সচিবকেও পাঠানো হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে গুম ও খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন এখন পলাতক। রিপোর্ট