নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে সময়ক্ষেপণ করছে সরকার। ওই ঘটনায় এই তিন কর্মকর্তাকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) তাদের নিজ নিজ কর্মস্থল থেকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তাদের গ্রেফতারে ঢিলেমি করায় ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার বিষয়টি ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
হত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যসহ আরো অনেকেই বলছেন, ‘আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া’র নামে সরকার ওই তিন বিতর্কিত র্যাব সদস্যদের আইনি বিড়ম্বনা এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত ব্যক্তিকে প্রথমে অপহরণের পর অভিযুক্তদের গ্রেফতারে বিলম্ব করায় মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামি নূর হোসেন এবং তার সহযোগীরা অপহৃতদের হত্যা করে লোকালয় ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগ পায়।
ওই অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে তিন র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ উঠতে থাকায় তাদের অবসর নিতে বাধ্য হয় সরকার। তবে নিহত নজরুলের বিধবা স্ত্রী’র দায়ের করা মামলায় তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়নি।
নিহত নজরুলের পরিবার ওই র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এরপর ঘটনার সন্দেহভাজন হিসেবে সাবেক ওই র্যাব সদস্যদের ‘অবিলম্বে’ গ্রেফতার করতে গত রোববার উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা নূর হোসেন ও তার অন্যান্য সহযোগীদের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন।
মঙ্গলবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, বুধবার একটি আদালতে ওই তিন র্যাব সদস্যের আত্মসমর্পণ করার কথা রয়েছে। একই দিন সকালে তিনি সচিবালয়ে বসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অভিযুক্ত র্যাব সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য যাবতীয় আইনগত আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
একইদিন সংবাদসংস্থা ইউএনবি তাদের একটি প্রতিবেদনে কামালের একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছিল- “উচ্চ আদালতের রায় এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং বুধবার (গতকাল) নাগাদ তাদের গ্রেফতার করা হবে।”
কিন্তু এখন অবধি তাদের কেউই আত্মসমর্পণ তো করেননিই, গ্রেফতারও হননি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এলিট ফোর্সটিকে কোনো দিক থেকেই অসন্তুষ্ট না করে সরকার ওই তিন অভিযুক্ত র্যাব সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায়।
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, র্যাবের ওই তিন সদস্যদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। কারণ এর ফলে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তির ওপরেই একটি ‘নেতিবাচক প্রভাব’ পড়বে।
একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “সরকার চাইছে লাঠি না ভেঙেই সাপ মারার নীতিটি অবলম্বম করতে। এই কারণেই এই গ্রেফতার প্রক্রিয়া এত বিলম্বিত হচ্ছে।”
একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে এই বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে- সরকারবিরোধী আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির-হেফাজতের উত্থানকে কঠোরভাবে দমনের বিষয়ে ওই সংকটময় পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই এলিট ফোর্সটি, অবদান রেখেছিল জঙ্গিবাদ দমনেও। কাজেই তাদের সেসব কর্মকাণ্ডকে নিচু করে বা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়- এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে না।
সাবেক ওই তিন র্যাব সদস্য হলেন র্যাব-১১’র লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এসএম মাসুদ রানা।
এদের মধ্যে তারেক, যিনি র্যা ব-১১’র কমান্ডিং অফিসার ছিলেন, তিনি সম্পর্কে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা।
যখন নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম এলিট ফোর্সটির ওই সদস্যদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন, তারপরেই গত ৬ মে তাদের অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু বুধবার শহীদুল জানান, একটি নির্দিষ্ট দল তাকে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আর কোনো কথা না বলার নির্দেশ দিয়েছে।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা জানান, ওই তিন র্যাব সদস্যের গ্রেফতার করা হয়েছে এমন সংবাদের আশায় গতকাল তারা টেলিভিশনের সঙ্গে সেঁটে ছিলেন।
নিহত সাত ব্যক্তির একজন, মনিরুজ্জামান স্বপনের মা মমতাজ বেগম বলেন, “আমরা দিন দিন আশা হারাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন যে সব অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু এই আশ্বাসের পর ওই তিন কর্মকর্তাকে এখনো গ্রেফতারই করা হয়নি।”
মামলার অভিযোগে নাম উল্লেখ করা ছয় আসামিসহ তিন র্যাব সদস্যের কেউই এখনো গ্রেফতার না হওয়ায় নিজের হতাশার কথা ব্যক্ত করেন একই ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীরের মা মেহেরুননেসাও।
নূর হোসেনের সহযোগীদের কি গ্রেফতার করা হয়েছে?
অনিশ্চিত সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র সদস্যরা যশোর সীমান্ত থেকে নজরুল হত্যা মামলার তিন নম্বর অভিযুক্ত আসামি হাসমত আলী হাসুকে গ্রেফতার করেছে।
কিন্তু এই গ্রেফাতারের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন যশোরের বিজিবি ২৬ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান এবং ২৩ ব্যাটালিয়নের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান।
নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেন এই হাসু।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, হাসুকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনিও শুনেছেন তবে এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
যদি এই গ্রেফতারের খবর সত্যি হয় তাহলে অপহরণের ১৭ দিন পরে হাসুই হবেন গ্রেফতারকৃত প্রথম আসামি।
এর আগে পুলিশ সন্দেহভাজন ২১ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে।
সুর বদলালেন মায়া
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত নিজ জামাতার বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে বুধবার সুর কিছুটা বদলিয়েছেন মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব হত্যাকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক এমনটা তিনি নিজেও চান।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জের হত্যার ঘটনায় যারা জড়িত, তারা যেই হোন না কেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এই ব্যাপারে আমিও সাহায্য করতে প্রস্তুত।”
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এর গত শুক্রবার তার পরিবারের কোনো সদস্যই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে মায়া যে মন্তব্য করেছিলেন তা নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করায় মায়া এই বিষয়ে নিজের অবস্থান বদলেছেন। সূত্র: ডেইলি স্টার