ডেস্ক রিপোর্ট : নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর সংশ্লিষ্টতায় সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে র‌্যাবের সংস্কার বা বিলুপ্তির দাবি জানানো হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও র‌্যাবের চাকরিচ্যুত সাবেক তিন কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার না করায় এই বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার অপরাধ কর্মকা-ের শাস্তি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে অবিলম্বে র‌্যাব বিলুপ্ত না করলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। র‌্যাবকে ‘সিরিয়াল কিলার’ এবং সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্ক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে দলটি। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা র‌্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন, বর্তমান সরকার জনগণের ওপর নির্ভর না করে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার ফলে এসব বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় গতকাল দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা খোলাখুলি কথা বলেছেন নয়া দিগন্তের সাথে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত জঘন্য ও বর্বর। এ ঘটনাকে কলঙ্কজনক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার বিচার চাই। তবে আদালতের নির্দেশের পরও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটি প্রক্রিয়াধীন বলা হচ্ছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, অপহরণের পর নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা সব মানুষের মনে দাগ কেটেছে। মানুষ এ সরকারের কার্যক্রমকে ঘৃণা করছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত খুনের ঘটনা সম্পর্কে যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তা প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে থাকা ব্যক্তির মুখে মানায় না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন না।
তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার না করা আমাদের জাতীয় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কারণ উচ্চ আদালতের আইন অমান্য করা ঠিক নয়। আসামিদের গ্রেফতার না করার বিষয়টি বিচারব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।
র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি প্রসঙ্গে ড. এমাজউদ্দীন বলেন, র‌্যাব হচ্ছে একটি বিশেষায়িত বাহিনী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে উদ্দেশ্যে এ বাহিনী গঠন করেছিলেন তার প্রয়োজনীয়তা এখন নেই। র‌্যাব বিলুপ্ত করার ব্যাপারে সাধারণ জনগণ দাবি তুলেছে, এটিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন, র‌্যাবকে তো টাকার বিনিময়ে হত্যার লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এ বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের কার্যক্রম এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সুতরাং র‌্যাব দ্রুত বিলুপ্ত করা সময়ের শুধু নয় জনগণের দাবি।
তবে দেশের আইনশৃক্সখলা বজায় রাখতে প্রয়োজনে একটি এলিট বাহিনী গঠনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, র‌্যাব বিলুপ্ত করে একটি এলিট বাহিনী গঠন করা যেতে পারে। সেই সাথে বাহিনীর জবাবদিহিতা ও কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে এ বাহিনীতে কোনো স্বচ্ছতা নেই।
ড. এমাজউদ্দীন আরো বলেন, ১৯৭৪-৭৫ সালের রক্ষীবাহিনীর আদলে কাজ করছে বর্তমান র‌্যাব। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে রক্ষীবাহিনীর আয়ু যেমন শেষ হয়েছিল, ঠিক তেমনি র‌্যাবেরও আয়ু শেষ হবে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. মো: এনামুল হক নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে দেরি করা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল পরস্পরকে দায়ী করছে। বিষয়টি নিয়ে ‘ব্লেইম গেম’ শুরু হয়েছে। তবে আজ হোক কাল হোক উচ্চ আদালতের নির্দেশ মান্য করতেই হবে।
র‌্যাব বাহিনীর বিলুপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই তিনজনের কারণে পুরো বাহিনীকে দোষারোপ করা ঠিক না। তবে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাবের বিরুদ্ধে খুন, গুম এবং অপহরণের যেসব অভিযোগ উঠেছে সেসব ব্যাপারে জরুরি তদন্ত করে দেখা দরকার। আসলেই র‌্যাব বাহিনী আমাদের ক্ষতি করছে না উপকার করছে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে নজরদারি ও তৎপরতা বাড়াতে হবে। সাথে সাথে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।
সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শুধু পুলিশ বা র‌্যাবের বিরুদ্ধে তদন্ত নয়, একজন খুনের আসামিকে (সাত খুনের মূল আসামি নূর হোসেন) কী করে ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হলো সে বিষয়েও তদন্ত করা উচিত। কারা লাইসেন্স দিলো এবং এর পেছনের কারা ম“ দাতা হিসেবে কাজ করেছে সে ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন ড. এনামুল হক।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনালের (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশ থাকার পরও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা না হলে সরকারের বিশ্বস্ততা লোপ পাবে। আইনশৃক্সখলার আরো বেশি খারাপ পরিণতি হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কেও মানুষের মধ্যে ভিন্ন ধারণা সৃষ্টি হবে। যেহেতু সেনাকর্মকর্তারা র‌্যাবে নিয়োজিত আছেন।
র‌্যাব বাহিনীর কর্মকা- প্রসঙ্গে তিনি বলেন, র‌্যাব একটি ইনস্টিটিউশন। সেখানে ভালো-মন্দ থাকতেই পারে। র‌্যাবকে বিলুপ্ত করা ঠিক হবে না। কারণ বিএনপির আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন থেকেই র‌্যাবের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। কোনো বাহিনী যদি বিপথগামী হয় তার সব দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারের।
তিনি বলেন, র‌্যাব বিলুপ্ত করাটা বড় কথা নয়। তাদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। বিএনপি আমলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ফলে অনেক ঘটনা ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসে ঘটনাগুলো বেশি বলেই মানুষ কথা বলছে।
র‌্যাব পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন বা সংস্কারের তাগিদ দিয়ে সাবেক এ সেনাকর্মকর্তা বলেন, র‌্যাবকে জনগণের সামনে নিয়ে আসা ঠিক না। এ বাহিনীকে এলিট বাহিনী হিসেবেই রাখা উচিত। আইনশৃক্সখলা রক্ষার জন্য র‌্যাবকে নয় বরং পুলিশের মধ্য থেকে আরো এলিট বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। র‌্যাবের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করে আরো কার্যকর কিভাবে করা যায় তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। সেই সাথে র‌্যাবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সে ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান তিনি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, অভিযুক্ত র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে যত দেরি হবে, আদালতের নির্দেশ মানার ব্যাপারে সরকারের অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ততই পরিষ্কার হয়ে উঠবে, যা ঠিক নয়। র‌্যাবের কার্যক্রম ও বিলুপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তিন বছর আগ থেকেই র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ র‌্যাব ঠা-া মাথায় মানুষ খুন করে। সে বাহিনীর কোনো দরকার নেই।
শাহদীন মালিক বলেন, তবে দেশের মানুষ শুরুর দিকে র‌্যাব ঠা-া মাথায় খুনকে মেনে নিয়ে উৎসাহ দিয়েছে। যে কারণে র‌্যাবের খুনখারাবি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এখন থেকে দেশের মানুষকে শিক্ষা নিতে হবে। বুঝতে হবে যে, দেশের কোনো সমস্যার সমাধান আইনের বাইরে নেই। আইনের ভেতরে থেকেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সবশেষে র‌্যাব বিলুপ্তির ওপর জোর দেন বিশিষ্ট এই আইনজীবী।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে সরকার আরো আগেই গ্রেফতার করতে পারত। শুধু তাই নয়, অপহরণের বেশ কিছু দিন পর মূল আসামি নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অথচ এসব কিছু নিজে থেকেই করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার তা করেনি। আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও আসামিদের এবং চাকরিচ্যুত র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার না করায় জনগণের মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। মূলত দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ফলে এসব হচ্ছে।
র‌্যাবের কার্যক্রম ও বিলুপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেজন্য র‌্যাবের ভূমিকা পরিবর্তন করতে হবে। এ বাহিনীকে ‘কমান্ডো ফোর্স’ হিসেবে কাজ করা উচিত। কারণ র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে কাজ করার জন্য। পুলিশের মতো আইনশৃক্সখলা রক্ষার কাজে নয়। তিনি বলেন, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এ বাহিনীকে এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। র‌্যাবের কর্মকর্তারাও অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব বন্ধ করে র‌্যাবের ভূমিকা পরিবর্তন করতে হবে। তাদের ‘কমান্ডো ফোর্স’ হিসেবে কাজ করা উচিত।
পুলিশের আরেকজন সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম সাত খুনের ব্যাপারে অভিমত দিতে গিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার আদালত ও আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেনি। কেন সরকার গ্রেফতার করছে না এ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ না মানার বিষয়টি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, এসব থেকেই বুঝা যায় বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকার আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। চাকরিচ্যুত র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নেই।
র‌্যাবের কর্মকা- প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক বলেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা ও জানা যাচ্ছেÑ দেশের বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে র‌্যাবের পরিচয়, পোশাক ও গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু র‌্যাব গুমের কথা অস্বীকার করলেও তাদের নাম ভাঙিয়ে এবং পোশাক ও গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। বরং ঘটনাগুলো অস্বীকার করছে। তবে এসব রহস্য উদ্ঘাটন করা না করার সব দায়দায়িত্ব র‌্যাবেরই।
আব্দুল কাইয়ুম আরো বলেন, আইনশৃক্সখলা বাহিনী বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীন। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে তারা ব্যর্থ। সরকার ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, যে বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাদের ওপর জনগণের কোনো আস্থা থাকে না। সুতরাং যে বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা নেই সে বাহিনী দেশে থাকা বিপজ্জনক। নদি