ডেস্ক রিপোর্ট : মামলা নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপিকে। সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় আদালতে হাজিরা দেয়ার কারণে অনেক নেতা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। আবার মামলার কারণে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় অনেক সিনিয়র নেতা দলীয় কর্মকা-ে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এছাড়া মামলাকে সামনে রেখে দল ভাঙারও ফাঁদ পাতা হচ্ছে, তবে নেতারা এখনো সেই ফাঁদে পা দেননি।
বিএনপি নেতারা জানান, মামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকার ষড়যন্ত্রের জাল পেতেছে। মামলার ভয় দেখিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে ‘নিষ্ক্রিয়’ করে রাখা হয়েছে। মামলার জালে ফেলে কাউকে কাউকে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং একই মামলায় রায়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখে দলের ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও কোনো কোনো নেতাকে সন্দেহ করছেন। দলের মধ্যে কেউ সরকারের এজেন্ট, কেউ বিশেষ সংস্থার লোক বলেও প্রচারণা বাড়ছে।
মামলার সংখ্যা এত যে, অনেক নেতাই তার বিরুদ্ধে কতটি মামলা রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি দলের বেশিরভাগ নেতার মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াও। দলের স্থায়ী এবং নির্বাহী কমিটির সিনিয়র নেতা ও আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার দেয়া তথ্য আনুযায়ী শীর্ষ থেকে শুরু করে সারাদেশে এ মামলার সংখ্যা হবে প্রায় ৩০ হাজার। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই তিন হাজারের মতো মামলা হয়েছে। আর এসব মামলার আসামি দুই থেকে আড়াই লাখের মতো নেতাকর্মী। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গড়ে প্রায় ১০টি মামলা রয়েছে।
তিনি বলেন, সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১২, মওদুদ আহমদ ১৮, এমকে আনোয়ার ৮, হান্নান শাহ ২০, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ২৩, মির্জা আব্বাস ৪৬ ও গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা রয়েছে। এছাড়া তরিকুল ইসলাম, জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ড. আর এ গণি, শামসুল ইসলাম, সারোয়ারী রহমান ও আব্দুল মঈন খানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে এম মোর্শেদ খান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শমসের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের সময়ে গড়ে ৫টি করে মামলা হয়েছে। আর সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আনুমানিক ১৩টি। এবং সাত যুগ্মমহাসচিব সবার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের করা হয়েছে অসংখ্য মামলা। এছাড়া প্রতিটি অঙ্গ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা। অঙ্গসংগঠনের মধ্যে যুবদলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১১০, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের বিরুদ্ধে ৫৩, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবউন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৩, সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর নামে রয়েছে ২২টি করে মামলা। ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলের নামে ৪৭টি ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবের নামে ৯৫টি মামলা রয়েছে। আর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নামে ১১০টি মামলা রয়েছে।
জানা গেছে, মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে সাংগঠনিক কর্মকা-ে সময় দিতে পারছেন না বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। দলীয় কর্মকা-ের চেয়ে মামলা মোকাবেলায় আইনজীবীদের চেম্বারেই বেশি সময় দিতে হচ্ছে তাদের। প্রতিদিন সকালে যখন দলীয় কর্মকা-ে নেতাদের ব্যস্ত থাকার কথা তখন দলের সিনিয়র নেতাসহ অনেককেই আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। এসব মামলায় নীতিনির্ধারকসহ অনেক নেতা ধারাবাহিকভাবে কারাভোগ করছেন। ফলে বারবার ব্যাহত হচ্ছে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ।
এদিকে মামলাকে কেন্দ্র করে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে দলের ভেতরে অল্প-বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। কেন তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে থাকছেন, তা নিয়ে গুঞ্জনের ডালপালাও ছড়িয়েছে। কেউ বলছেন, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত। অনেকের ধারণা, কারাগারের নিঃসঙ্গতা ও কষ্ট এড়াতেই এই কৌশল।
সম্প্রতি দুদকের একটি মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কারাগারে গেছেন। তার গ্রেপ্তারের বিষয়টিও ওই চক্রান্তের অংশ বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। তাদের ধারণা, কারাগার থেকে বের হতে হলে তাকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে, থাকতে হবে নিষ্ক্রিয়। নইলে কারাগারেই থাকতে হবে। এমনকি কারাদ-ও হতে পারে।
বিএনপির সব কর্মসূচিতে বেশ সক্রিয় থাকতেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে প্রায়ই তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে দেখা যেত। জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপি সমর্থক বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে তিনি থাকতেন নিয়মিত। মিডিয়া কাভারেজ খুবই পছন্দ করেনথ তার সম্পর্কে এমন ধারণাও আছে। সেই মওদুদ আহমদ এখন একেবারেই আড়ালে। কেন এই অবস্থা? এমন প্রশ্নের জবাব মওদুদের কাছে পাওয়া যায়নি। মিডিয়াকে একেবারেই এড়িয়ে চলছেন তিনি। তার চেম্বারে ফোন করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, ‘স্যার এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।’
একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলে মওদুদ আহমদের গুলশানের বাড়িটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি একেবারেই চুপসে গেছেন।
গত ৪ ফেব্র“য়ারি মুক্তি পান মওদুদ আহমদ। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবিস্নউ মজিনার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেন তিনি। কিন্তু দলীয় কর্মসূচিতে থাকেন না।
একইদিনে গ্রেপ্তার হওয়া স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এমকে আনোয়ারও একেবারেই চুপচাপ। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তিনি। দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত থাকতেন। মুক্তি পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো কর্মসূচিতেই দেখা যায়নি তাকে। সর্বশেষ ১৯ ও ২০ মার্চ বিএনপির লংমার্চেও যাননি তিনি। অথচ কর্মসূচির এক দিন আগেও তাকে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে।
একই অবস্থা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের ক্ষেত্রে। সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া এই নেতার ইদানীং দেখা মিলছে না। যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে একাধিবার কারাগারে গিয়ে আবার মুক্তি পেলেও কখন তিনি বের হলেন, কখন জেলে গেলেন, তা টেরই পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলাকে সামনে রেখে বিএনপি ভাঙারও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দলের একটি অংশকে দিয়ে পৃথক বিএনপি গঠনের চক্রান্ত চলছে। এর আগেও সরকারের রোষানলে পড়ে বিএনপিতে ভাঙনের সুর বেজেছে। কখনো সরকারের চাপে, কখনো বা দলের ওপর রুষ্ট হয়ে পৃথক দল করেছেন কয়েকজন নেতা। ভাঙা-গড়ার এই খেলায় বারবারই বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পর বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। বিএনপি ভাঙার অতীত চেষ্টা বিগত সময়ে ফলপ্রসূ হলেও এবার তা সহজে হচ্ছে না। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৬ দফা দলটি ভাঙনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আতঙ্ক আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার বৈঠক হয়। ওই সময় ঢাকা মহানগর বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গেও তাদের বৈঠক হয়। তাকে দিয়ে দল ভাঙার চেষ্টা করা হলেও তিনি রাজি হননি। উল্টো গোপনে সংস্কারপন্থীরা যাতে আবারো ডিগবাজি দিতে না পারে, সেজন্য তাদের ম্যানেজ করেন। পাশাপাশি অন্য ছোট দলগুলো যাতে সরকারের ফাঁদে পা না দেয়, তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে রাজপথের আন্দোলনে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না হলেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করা নিয়ে সমালোচনায় পড়তে হয় তাকে। এজন্য তাকে খালেদা জিয়ার কাছে জবাবদিহিও করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলার কারণে নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা, একই মামলায় রায়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং সরকারের সঙ্গে আঁতাতের বিষয় নিয়ে দলের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিগত সময়ে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে পরিচিত নেতাদের সমালোচনা করছেন প্রতিনিয়ত। এটা শুধু মাঠ পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে শীর্ষ পর্যায়েও। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে দুই নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রকাশ্যে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তারা একে অপরকে সরকারের ‘দালাল’ বলে অপবাদ দেন।
এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এসব মামলার কারণে সাংগঠনিক কর্মকা-ে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। দলীয় কর্মকা- ফেলে নেতাকর্মীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। মামলা মোকাবেলায় ব্যস্ততার কারণে কোনো সাংগঠনিক কাজ করা যাচ্ছে না।
বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, মামলার কারণে স্বাভাবিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সপ্তাহে ৪ দিন আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার ষড়যন্ত্র করে একের পর এক মামলা দিচ্ছে। বিগত সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখনো হয়তো দলের এবং দেশের ভেতরে-বাইরে বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের এগুলো প্রতিরোধ করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। দলের ভেতরের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেন, শুধু রাজনীতি নয়, ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মামলার কারণে। সাংগঠনিক কার্যক্রমে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার একের এক মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের ব্যতিব্যস্ত রাখছে। যাযাদি