দীর্ঘ খরার কবলে দেশ। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অঞ্চল ছাড়া খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে কাক্সিক্ষত বৃষ্টি নেই। গত এপ্রিল মাসটিও গেছে খরায়। অব্যাহত তাপপ্রবাহে শুকিয়ে গেছে নদী, বিল ও পুকুরের পানি। দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় পানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে বেশ কিছু এলাকায় সাধারণ টিউবওয়েল থেকে এখন আর পানি উঠে না। ভরসা শুধু ডিপ-টিউবওয়েল। গত মার্চ মাস থেকে অনাবৃষ্টির কারণে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় ফসলের পাতা শুকিয়ে গেছে। বরেন্দ্র এলাকায় আম ও লিচুর ফলনের ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে। সরবরাহ কমে যেতে পারে সুস্বাদু এ দুই ফলের। অনাবৃষ্টির প্রভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হলে আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তায় চাপ পড়তে পারে বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। একই সাথে তীব্র অভাব দেখা দেবে মাছের। ছোট মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলন কম হওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে শাকসবজির দামও।
আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে যে, চলতি মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হতে পারে। গত এপ্রিল মাসে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৯ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এপ্রিল মাসে সারা দেশে প্রায় এক মিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ ছাড়া মে মাসে বাংলাদেশে প্রায় দুই মিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। চলতি মাসে গত ১৪ দিনের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হিসাব করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসতে পারে যদি সামনের দিনগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাত না হয়। অবশ্য সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এ দুই বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে এ অঞ্চলের পরিবেশ ও ভূপ্রকৃতির ধরনের কারণে। তা ছাড়া নিচু অঞ্চল হওয়ায় ভারতের পাহাড়িয়া অঞ্চল থেকে আকস্মিক ঢলের পানি সিলেট এলাকার নদী এবং নিচু এলাকা মাঝে মধ্যে ভাসিয়ে দেয়।
সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ছে। অনেক এলাকায় পানিতে উঠে আসছে আর্সেনিক। দেখা দিয়েছে আর্সেনিকজনিত নানা রোগের। তীব্র তাপপ্রবাহে মাটি শুকিয়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাপের কারণে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশি ও হিটস্ট্রোকের মতো রোগ দেখা দিচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ থেকে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। এপ্রিলে ঢাকায় ও যশোরে ৫৪ বছর পর তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হয়েছে। ২৪ এপ্রিল যশোরে সর্বোচ্চ ৪২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠে। গত বুধবার সাতক্ষীরায় ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলগুলোর উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং মাইজদীকোর্ট অঞ্চলসহ ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ বিভাগের উপর দিয়ে মাঝারি থেকে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান গতকাল বৃধবার জানিয়েছেন, শুধু সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের অঞ্চলগুলো ছাড়া দেশের অবশিষ্ট অঞ্চলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলে হতেও পারে। তবে এ বৃ্িষ্টতে মাটি না-ও ভিজতে পারে। এ দিকে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ থেকে একটি নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে নিম্নচাপটি স্পষ্ট হতে পারে। এটা স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হলে হয়তো ঝড়ে রূপ নেবে। এর সাথে কিছু বৃষ্টি হতে পারে। আর এটা সাগরেই শেষ গেলে বৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকবে না।
তাপদাহে জ্বলছে যশোর
যশোর অফিস জানায়, চলতি মওসুমজুড়েই তীব্র তাপদাহে যশোর জ্বলছে। বৈশাখ শেষ হলেও এখনো বৃষ্টি হয়নি। হওয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ মওসুমে জেলায় তাপমাত্রা ওঠে সর্বোচ্চ ৪২.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এখন ঘোরাফেরা করছে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে। মঙ্গলবার ছিল ৪০.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিসের ভাষ্যমতে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত মৃদু ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত মাঝারি ৪০ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। চলতি মওসুমের প্রায় পুরোটাই যশোর তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে। এর প্রভাবে যশোরের নদ-নদী, পুকুর, জলাশয় সব কিছু শুকিয়ে গেছে।
বিএডিসির পানি পরীক্ষাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি জানান, পানির স্তর ২৫ ফুটের নিচে নেমে গেলে নলকূপে পানি ওঠে না। কিন্তু যশোরের অধিকাংশ এলাকায় পানির স্তর ৩৩ ফুটের বেশি নিচে নেমে গেছে।
বৃষ্টি না হওয়ায় যশোরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মাছ চাষের। যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রমজান আলী জানান, যশোরে চলতি বছর এক লাখ ২০ হাজার টন মাছ উৎপাদনের ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর দাম প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে রেণু উৎপাদন করা হবে এক লাখ ৬০ হাজার কেজি। রেণুর ওপরই নির্ভর করে মাছ উৎপাদনের বিষয়টি। কিন্তু খরার কারণে রেণু উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়েছে তেমনি তীব্র তাপে পুকুর ও জলাশয়ের রেণু মরে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে এবার মাছের উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কম হবে।
খাঁ খাঁ করছে নওগাঁর মাঠঘাট
নওগাঁ সংবা“াতা জানান, জেলায় তীব্র তাপদাহে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কোনোভাবেই কমছে না গরমের মাত্রা। তপ্ত রোদে মাটি ফেটে চৌচির হওয়ার উপক্রম। পিচের রাস্তায় পা ফেলার উপায়ও নেই। পুকুর-খাল-বিল শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। নদীতেও পানি নেই। চারদিকে শুধু ধু-ধু বালুচর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। গভীর ও অগভীর নলকূপেও পানি আসছে না ঠিক মতো। সেচ নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা। তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ এবং প্রাণিকুল। গরমের কারণে নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে জনজীবন অচল হওয়ারও উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে দুস্থ দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট পৌঁছেছে চরমে। ফলে প্রচ- তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নওগাঁ জেলার ১১ উপজেলার মানুষ। সেই সাথে লোডশেডিং মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসে আগুনের হল্কা ছড়িয়ে পড়ায় স্বস্তি নেই কোথাও। বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না সূর্যের প্রখর তাপে। ঘরে থাকা যাচ্ছে না বিদ্যুতের অভাবে।
তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় আম, শশা, তরমুজ, ডাবসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ বছর জেলায় মোট ১১ উপজেলায় ছয় হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে পোরশ উপজেলায় তিন হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। প্রচ- খরতাপে আমের বোঁটা শুকিয়ে অকালে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। আমচাষিরা আমের ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। পোরশা উপজেলা সদরের এক আমচাষি রফিকুল ইসলাম জানান, প্রচ- খরতাপে আমের বোঁটা শুকিয়ে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। এবার আমের ফলন কম হবে।
রংপুরে বৃষ্টির জন্য হাহাকার
রংপুর অফিস জানায়, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ফের শুরু হয়েছে তাপদাহ। গত বছরের চেয়ে এপ্রিল মাস থেকে প্রতিদিনই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে এই অঞ্চলে চলছে স্মরণকালের মরুভূমির উত্তাপ; মরুদাহ। দেখা মিলছে না বৃষ্টিরও। সাথে বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং জনজীবনের স্বাভাবিক যাত্রাকে করে দিয়েছে স্তব্ধ। বিভিন্ন রোগের উপদ্রব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়া অফিস কবে নাগাদ বৃষ্টি হতে পারে তার কোনো সম্ভাবনার কথাও বলতে পারছে না।
রংপুর বন বিভাগের রেঞ্জার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মনজুরুল করিম নয়া দিগন্তকে জানান, দেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার দরকার। কিন্তু নির্দয়ভাবে বন ও গাছপালা উজাড় হওয়ার কারণে তা ৫ ভাগে নেমে এসেছে।
সকাল থেকে গভীর রাত অবদি থাকছে তাপদাহ। ফলে মানুষের হাপিত্যেস উঠে গেছে। স্বাভাবিক চলাফেরায়, কাজকর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা। রাস্তার পাশে গাছের নিচের ছায়ায় উদোম শরীরে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করছে মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা আরো করুণ। রিকশা চালানো, কলকারখানায় কাজ এবং জমিতে শ্রমিকের কাজ তারা গরমের কারণে করতে পারছে না। গরমে শরীর নেতিয়ে পড়ছে। তারা কাজ করতেও পারছে না, বাদও দিতে পারছে না।
রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ এই অঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রিহাইড্রেশন, ডিহাইড্রেশন, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ গরমজনিত বিভিন্ন ধরনের রোগী ভর্তির হিড়িক পড়ে গেছে।
লালমনিরহাটে প্রচ- তাপদাহ
লালমনিরহাট সংবা“াতা জানান, উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় বরফগলা বাতাসের সংস্পর্শে শীতকালে যেমন প্রচ- শীত এবং গরমের সময়েও বরফগলা গরম পানির সংস্পর্শে বাতাস গরম হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রচ- তাপদাহের মধ্যেও ঘন ঘন লোডশেডিং হওয়ায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এ দিকে জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ৩০টি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় গরমের মাত্রা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
প্রচ- খরায় জমির রস কমে যাওয়ায়, কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে। নিচু জমিগুলো পানির অভাবে ফেটে চৌচির হচ্ছে। একাধিক কৃষক জানান, চৈত্র মাসের শেষে জমিতে তোষা পাট রোপণ করার পরও আজ পর্যন্ত চারা গজায়নি। পানি নেই ছোট নদীগুলোতে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অপর দিকে প্রচ- গরমে বেশি সমস্যায় পড়েছেন জেলখানার কয়েদিরা।
রংপুর আবহাওয়াবিদ আতিকুর রহমান জানান, বর্তমানে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৩ পয়েন্ট বেশি। লালমনিরহাটসহ রংপুর অঞ্চলে মে মাসের প্রথম দিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৯.৪ সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে তাপমাত্রা ৩১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে।
কাঠফাটা রোদে পুড়ছে কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রাম সংবা“াতা জানান, বৈশাখের কাঠফাটা রোদ ও গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে গোটা জনপদ। প্রচ- খড়ায় ও গরমে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না মানুষজন। বৈশাখের শেষে এসেও অনাবৃষ্টির কারণে খাল-বিল, নদী-নালা এখনো শুকনো রয়েছে। এ সময় নদী-নালা, খাল-বিল বৃষ্টির পানিতে ভরে যাওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির অভাবে চারদিকে শুধু খাঁ খাঁ করছে। কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীতে পানি নেই বললেই চলে। গত ১৫ দিন থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টির দেখা নেই। আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ও হিটস্ট্রোকজনিত রোগ। প্রতিদিন শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে দুই শতাধিক রোগী। এদের অধিকাংশই শিশু।
প্রচ- গরমে বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগ। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে শুধু ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিচ্ছে দুই শতাধিক রোগী। এদের অধিকাংশই শিশু ও বৃদ্ধ।
খরার প্রভাব পড়ছে আম ও লিচুর মুকুলে। অনেক গাছের মুকুল খরায় শুকিয়ে ঝড়ে গেছে অনেক আগেই। যেটুকু মুকুলে ফল এসেছিল তাও শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। খরার প্রভাব পড়েছে পাটচাষেও। বৃষ্টির অভাবে পাটের আশানুরূপ ফলন পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন কৃষকরা।
কুষ্টিয়ায় তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন
কুষ্টিয়া সংবা“াতা জানান, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামের কালু মিয়া, হাতেম আলী, তফেল, রাশেদুল, আব্দুল্লাহ, গিয়াস, নুরুদ্দিন, কেরামত, মক্কেল, কাশেম, ইরাজ, শহিদুল্লাহ, বারী, সানাউল্লাহসহ আরো অনেকে ঠেলাগাড়ি চালান। সবার বয়স ৬০-এর কাছাকাছি। গত বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায় বাড়ি থেকে ২ মাইল হেঁটে নদী পার হয়ে শহরের থানা মোড়ে পৌঁছতে তাদের সময় লেগেছে এক ঘণ্টার বেশি। মাঝে কয়েকবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। এর মধ্যে পুরো গা ঘেমে ভিজে গেছে শরীরের কাপড়গুলো। তাদের ভাষায় জীবনের এত সময় পার করে দিয়েছি এত গরম কখনো দেখিনি।
গত ১৫ দিনে কোনো বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া জেলার সর্বত্র একই পরিবেশ বিরাজ করছে। এলাকার কৃষিকাজে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বোরো ধান কাটা আর আউশ ধান লাগানোর শ্রমিক না পেয়ে কৃষকেরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আবার যারা আউশ ধান রোপণ করেছে সেসব ধান পানির অভাবে পুড়ে যাচ্ছে। এই তাপদাহে জেলার নদীকূলবর্তী এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কষ্টে জীবনযাপন করছে বলে সরেজমিন দেখা গেছে। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদী ও গড়াই নদী শুকিয়ে গেছে। পদ্মা ও গড়াই নদীতে শুধুই ধু-ধু বালুচর। গড়াই নদী হেঁটে পার হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। এই রৌদ্রের প্রচ- তাপদাহ সহ্য করেই শহরের কাছে হরিপুর ও কয়া ইউনিয়ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে হেঁটে পার হয়ে কুষ্টিয়া শহরে আসছে প্রতিদিন। প্রখর রৌদ্রের তাপে গাছের পাতার রং পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে হাসপাতালগুলোতে গরমজনিত রোগীর চাপ বেড়েছে। শিশু এবং বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেশি। হিটস্ট্রোকে অনেক রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজে গত কয়েক দিন রোগীর চাপ খুব বেশি। রোগীর চাপ সামলাতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নীলফামারীতে খরার কবলে পাটচাষিরা
নীলফামারী সংবা“াতা জানান, খরার কবলে পড়েছে দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ নীলফামারী। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলার পাটচাষিরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাট আবাদ মারাত্মকভাবে তিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। খরার কারণে এ বছর নীলফামারীতে পাটের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। এ দিকে গত এক মাস ধরে এখানে প্রচ- তাপদাহ বিরাজ করছে। প্রতিদিনই তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। খরা ও তাপদাহের কারণে ইতোমধ্যে সৈয়দপুর উপজেলার সামাজিক বনায়নের শতাধিক গাছ মরে গেছে বলে জানা গেছে।
নীলফামারীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর একটানা দীর্ঘ খরা বিরাজ করছে। গত মার্চ মাস থেকে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার অনেক কৃষক পাটের বীজ ফেলতে পারেননি। এ অবস্থায় অনেকে পাটের বীজ ফেললেও খরার কবলে পড়ে তা পুরোপুরি গজায়নি। যেটুকু গজিয়েছে তা-ও রোদে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এ দিকে খরার কারণে এ বছর নীলফামারীতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার হেক্টর কম জমিতে পাটচাষ হয়েছে।
তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এ জনপদের খেটে খাওয়া বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নিম্ন আয়ের মানুষজন চরম কষ্টে পড়েছে। খরা ও তাপদাহে জেলার সৈয়দপুর উপজেলার সামাজিক বনায়নের তিন বছর আগে লাগানো চারাগুলোর ওপর প্রভাব পড়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার আইসঢাল পথিরামপাড়া থেকে দলুয়া তিন কিলোমিটার কাঁচা সড়কের দুই পাশের আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, শালট্রি, জামরুল, মেহগনি, বকাইন ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার গাছগুলো মরে যাচ্ছে।
খুলনায় স্মরণকালের তীব্র খরা
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনা অঞ্চলে মার্চ থেকে খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মাঝখানে শুধু মে মাসের প্রথমে দুই দিনে হালকা বৃষ্টিপাত হয়। এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়। চলতি মাসেও গরম অব্যাহত রয়েছে। গত মঙ্গলবারেও তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র ও দীর্ঘ খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবজি উৎপাদন। সেই সাথে আউশ ধান বোনা যাচ্ছে না। নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। ফলে তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অপরপক্ষে গরম আবহাওয়ায় মানুষ সর্দিজ্বর ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
মার্চের শেষভাগ থেকে গরমের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ। মাসজুড়ে তাপমাত্রা ছিল গড়ে ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২২ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। মে মাসে বৃষ্টিপাতের সময় কয়েক দিন তাপমাত্রা একটু সহনীয় ছিল। তারপর আবার বৃদ্ধি পেয়ে গরম অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। অপর দিকে তীব্র খরায় মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে আছে। খেতে আউশ ধান বোনা সম্ভব হচ্ছে না বলে কৃষকরা পড়েছেন দুর্ভাবনায়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা জেলায় তিন হাজার সাড়ে ৭০০ হেক্টর জমিতে শাকসবজি চাষ হয়েছে এবার। তীব্র খরায় সবজিচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবারের খরায় খুলনায় কৃষি অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি টাকা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
পঞ্চগড়ে ক্রমান্বয়ে নিচে নামছে পানির স্তর
পঞ্চগড় থেকে আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে ছোট বড় প্রায় ২০টি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদিতে পানিশূন্যতার কারণে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। নদীগুলোতে পানিপ্রবাহের সুব্যবস্থা করা না হলে খরা মওসুমে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। অপর দিকে পানির সুব্যবস্থা হলে গ্রামীণ জনপদে জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
জেলার সমতল ভূমির ওপর দিয়ে করতোয়া, ডাহুক, মহানন্দা, তালমা, ঘোড়ামারা, ছোট তিস্তা, বে-রং, গাবরা, তিরনই নদী, চাওয়াই, পাথরাজ ঝিনাই গুড়ি, কুড়-মসহ প্রায় ২০টি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদীর বেশির ভাগই ভারত থেকে এসেছে। ভারত বরাবরই নদীর স্রোতের গতিপথে বাঁধ নির্মাণ করে পানি অন্য দিকে প্রবাহিত করেছে। যার কারণে নদীর বাংলাদেশ অংশে পানির প্রবাহ নেই। উজানে বাঁধের কারণে খরা মওসুমে এসব নদী পানিশূন্য হয়ে যায়। পানিশূন্যতার কারণে নদীর তলদেশে পলিমাটি জমে মরা খালে পরিণত হয়ে নদীর অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় পানির স্তর অনেকটা নিচে নেমে যাচ্ছে। রসহীন হয়ে পড়েছে এলাকার মাটি। কৃষকরা রসহীন মাটিতে ফসলের বীজ বপন করলেও সহজে বীজ থেকে চারা গজায় না। চারা গজালে রসের অভাবে চারাগুলো মরে যাচ্ছে।
প্রবাহমান নদীগুলোতে পানিশূন্যতার কারণে বনে-জঙ্গলে, বাড়ির আশপাশে লাগানো সবুজ গাছপালা ক্রমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানিশূন্যতার কারণে আবাদের জমিজমা রসহীন হয়ে পড়েছে। ভারসাম্য হারাছে পরিবেশ। নদি