শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে হেফাজতে ইসলাম! অলিখিত ও অঘোষিত কিছু শর্তসাপেক্ষে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়ে একমত এখন উভয়পক্ষই। সরকারের বিরুদ্ধে থাকা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে আমিরের অফিস ও হেফাজতের সদর দপ্তর হাটহাজারী মাদ্রাসা লিজ পেয়েছে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের জমি। পাশাপাশি হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী দায়ের করা মামলাগুলোর বিষয়েও নমনীয় অবস্থান আদায়ের বিষয়েও সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছেন হেফাজত আমির। তবে সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার সরকারি সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে সমাঝোতার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে শিগগিরই। গেল বছরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেয়া কওমির সরকারি স্বীকৃতির বিরোধী অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে এসেছেন আহমদ শফী। সরকারের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থেকেই সনদের স্বীকৃতি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে কাটতে যাচ্ছে অর্ধকোটি গরিব ও এতিম কওমি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের সনদের সরকারি অনুমোদন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা।
হেফাজত আমিরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শেই সার্বিক বিষয়টি দেখভাল করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ। রাজধানীর এক হাসপাতালে আহমদ শফীর সঙ্গে আলোচনা শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে শেখ আব্দুল্লাহ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আল্লামা শফীকেই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্রুত কওমি সনদের স্বীকৃতির কাজটি শেষ করতে চান। আহমদ শফী এখন এ বিষয়ে পুরোপুরি পজিটিভ।
হেফাজত আমিরও তাকে বলেছেন, আমিও চাই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সনদের স্বীকৃতি হোক। আমি সুস্থ হয়েই এ বিষয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। আওয়ামী লীগ নেতা জানান, আহমদ শফীর মাধ্যমে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। জানা গেছে, গোপনে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই সমঝোতার জন্য কাজ করেছে হেফাজত নেতারা। সরকারের অবস্থানও ইতিবাচক। শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতায় পৌঁছেছে হেফাজতে ইসলাম। অলিখিত ও অঘোষিত কিছু শর্তেই ঐকমত্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সমঝোতার অংশ হিসেবেই হেফাজতের আমির পরিচালিত হাটহাজারী মাদ্রাসা লিজ পেয়েছে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের তিন একর জমি। বিশাল এই প্রাপ্তির বিনিময়ে হেফাজত নেতারা অঙ্গীকার করেছেন তারা আর বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করে কোন আন্দোলন করবেন না। পাশাপাশি হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিষয়েও নমনীয় হবে সরকার। হেফাজতের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছুদিন আগে শানে রিসালত নামে তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের আগেই গোপনে সরকারের সঙ্গে চলমান বিরোধ মিটিয়ে ফেলে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে হেফাজত। এরপরই হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী শানে রিসালত সম্মেলনে বলেন, সরকারের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। হাসিনা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ আমাদের বন্ধু। আসুন, আমরা সবাই ভাল হয়ে যাই। সবাই মিলে সুন্দর সোনার বাংলা গড়ে তুলি। আওয়ামী লীগ দেশে অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে। তারা না করলে দেশে এত মসজিদ মাদ্রাসা হতে পারত না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাটহাজারী মাদ্রাসাসংলগ্ন রেলওয়ের প্রায় তিন একর জমি তিন শতাধিক খুঁটি গেড়ে দখলে নিয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। সেখানে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে, ‘লিজ সূত্রে এই জমির দখলদার ও মালিক হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। কয়েক মাস আগে জমিগুলো লিজ নেয়ার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন হেফাজত আমির। সরকারের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতার আলোকেই তিনি জমি লিজের আবেদন করেছিলেন।
লিজের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নেয় রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আহমদ শফী রেলওয়ের প্রায় তিন একরের মতো জমি ও পুকুর মাদ্রাসার নামে লিজ পেতে আবেদন করেন। এ প্রসঙ্গে হেফাজত নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী অবশ্য দাবি করেন, হাটহাজারী মাদ্রাসার নামে রেলওয়ের কিছু জমি লিজ বরাদ্দ হচ্ছে। এই জমি অনেক আগে থেকেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দখলে আছে। আমিরের ছেলে আনাস মাদানী ও তার সহযোগীরা ইতোমধ্যে হাটহাজারী ঈদগাঁহ মাঠের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২০ কাঠা জায়গায় পাঁচটি বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। হেফাজতের অনেক নেতাই এখন বলছেন, বাস্তবতার কারণে হেফাজতের অধিকাংশ নেতা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গত বছরের ৫ মের ঘটনার বিষয়ে তাঁরা এখন গভীরভাবে অনুতপ্ত। তাঁরা সরকারের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি অবস্থান থেকে সরে আসতে চান। মূলত এ অবস্থানের কারণেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চান হেফাজতের আমির।
গত শনিবার অসুস্থ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাওলানা শফীকে দেখতে খিদমাহ হাসপাতালে যান শেখ আব্দুল্লাহ। সেখানে তিনি শফীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর সালাম পৌঁছান। তিনিও সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম পৌঁছে দিতে বলেন। এরপর আহমদ শফীর কাছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হতে প্রস্তাব করেন শেখ আব্দুল্লাহ। শেখ আব্দুল্লাহ জানান, প্রধানমন্ত্রী অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন অনতিবিলম্বে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রেক্ষিতেই আমি হুজুরের কাছে যাই। এরপর হুজুরকে জানাই, নেত্রী খুব দ্রুত চান আপনাকে কমিশনের চেয়ারম্যান রেখে আপনার মাধ্যমেই স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। তিনি আরও বলেন, এরপর আমি হুজুরকে চেয়ারম্যান হতে অনুরোধ করি। অনুরোধ জানানোর পর হুজুর আশ্বস্ত হয়েছেন এবং খুশি হয়ে বলেছেন, ‘আল্লারে ডাকেন আমি যদি অনতিবিলম্বে সুস্থ হলে আমি আশাবাদী প্রধানমন্ত্রীর এ ইচ্ছা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকব। আমি প্রস্তুত এবং রাজি আছি।’ হুজুর বলেছেন, আলোচনার ভিত্তিতে উভয়পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এ বিষয়ে আর কোনো জটিলতা নেই।
আ স