‘সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় এখন প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠছে। নূর হোসেনের বাহিনীর লোকজন ফের চাঁদা ওঠাচ্ছে। আর সেই টাকা নূর হোসেনের কাছে পাঠাচ্ছে তারা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এদিকে খেয়াল নেই। নূর হোসেনের সহযোগীরা তাঁদের সামনে দিয়ে চলাফেরা করলেও ধরার খবর নেই।’ এভাবেই অভিযোগ করলেন সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা ভেবেছিলেন, আর কোনো চাঁদাবাজের খপ্পরে পড়তে হবে না ব্যবসায়ী, পরিবহনচালকদের। কিন্তু না, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর দু-তিন দিন বন্ধ ছিল; এর পর থেকে নূর হোসেনের সহযোগীরা পুরোদমে চাঁদাবাজিতে নেমেছে। তারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠিয়ে সেই টাকা নূর হোসেনের কাছে পাঠাচ্ছে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এই অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও পাওয়া গেছে একই রকম তথ্য। নূর হোসেনের লোকজন নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে এবং চাঁদাবাজির একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে আত্মগোপনে থাকা নূর হোসেনের কাছে।
চাঁদাবাজি বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘এখানে নানা ধরনের গ্রুপ আছে। কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনোক্রমেই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস চালাতে দেওয়া হবে না।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন গতকাল বিকেলে বলেন, ‘শিমরাইলে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। এখানে আমরা নতুন এসেছি। সবাইকে চেনার সুযোগ এখনো হয়ে ওঠেনি। চাঁদাবাজদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘গোপনে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে, কোথাও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে কি না। তবে আমাদের কিছু নজরে পড়েনি।’
নূর হোসেন কোথায় : সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন কোথায়- এ প্রশ্ন এখন দেশবাসীর। কিন্তু ঘটনার পর ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তদন্তকরীরা। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৭ এপ্রিল সাতজনকে অপহরণের পর থেকেই নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে। অপহরণের পরপরই নিহত নজরুলের স্ত্রী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, নূর হোসেনকে ধরে চাপ দিলেই অপহৃতদের উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। র্যাবের কাছে গিয়েও কোনো ফল পাননি তিনি।
নূর হোসেনের বাড়ির পাশের বাড়ির এক ব্যবসায়ী জানান, ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নূর হোসেনকে সিদ্ধিরগঞ্জে তাঁর বাড়ি ও নারায়ণগঞ্জে দেখা গেছে। ৩০ এপ্রিল দুপুর ২টার দিকে জানাজানি হয় যে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। এর পর থেকেই আর নূর হোসেনকে এলাকায় দেখা যায়নি। এরপর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন গত রাতে বলেন, ‘নূর হোসেনকে গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নূর হোসেন পালিয়ে কোথায় রয়েছেন তা জানার জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া তাঁর গাড়ির চালক ও সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যদি নূর হোসেনের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হবে।
যেভাবে চাঁদাবাজি হচ্ছে : স্থানীয় সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ ও শিমরাইল এলাকা নূর হোসেনের সাম্রাজ্যে। সেখান দিয়ে প্রতিদিন ঢাকা থেকে শত শত বাস-ট্রাক দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়া-আসা করে এবং ঢাকায় প্রবেশ করে। আর প্রতিটি গাড়ির ক্ষেত্রে শিমরাইল এলাকায় চাঁদা দিয়ে যেতে হয়। শুধু দূরপাল্লার বাস থেকেই প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে শুরু করে টেম্পোচালকদেরও রেহাই নেই তাদের হাত থেকে। সূত্র জানায়, শিমরাইল এলাকা দিয়ে যাওয়া প্রতিটি দূরপাল্লার বাস থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর ওই এলাকার ট্রাকস্ট্যান্ডে ট্রাক রাখার জন্য দিতে হচ্ছে আড়াই শ করে টাকা। যদি কোনো ট্রাক মালামাল নিয়ে যায় তাহলে রেট ৫০০ টাকা। শুধু তা-ই নয়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পোরও মাফ পাওয়ার সুযোগ নেই। তাদেরও ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা গুনতে হয়। সূত্র জানায়, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বালু ব্যবসা থেকেও প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের চাঁদা ওঠাচ্ছে নূর হোসেনের সহযোগীরা।
যেভাবে টাকা যাচ্ছে নূর হোসেনের কাছে : একটি সূত্র জানায়, নূর হোসেন দেশে আছেন, নাকি দেশের বাইরে, তাঁর সহযোগীরা সে বিষয়টি জানে। নূর হোসেনের অবর্তমানে তাঁর সহযোগী জামাল, নজরুল, মনির, সেলিম, আলী মোহাম্মদ, সালাউদ্দিন ১৫ থেকে ২০ জনের দল তৈরি করে নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। আত্মগোপনে থেকে তাদের পরিচালিত করছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আরিফুল হক হাসান। তার মাধ্যমেই নূর হোসেনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা যাচ্ছে বলে একটি সূত্রের দাবি। ওই সূত্র জানায়, নূর হোসেন কলকাতায়ও থাকতে পারেন অথবা দেশেও থাকতে পারেন। যেখানেই থাকুন, তিনি যে রাজার হালে আছেন, সেটা তারা নিশ্চিত।
এরশাদ শিকদারকেও হার মানিয়েছেন নূর হোসেন : নূর হোসেন এরশাদ শিকদারকেও হার মানিয়েছেন বলে গণশুনানিতে জানালেন এলাকাবাসী। গত শনিবার সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার হাউসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গণসাক্ষ্য নেন। সেখানে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেকে নূর হোসেনকে খুলনার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, পরে ফাঁসি হওয়া এরশাদ শিকদারের চেয়েও ভয়ংকর বলে জানিয়েছেন। নূর হোসেনের এত প্রতাপশালী হওয়ার পেছনে র্যাব ও পুলিশের ভূমিকা রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা। তদন্ত কমিটির এক সদস্য গতকাল রবিবার জানান, যাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা অভিযোগ করেছেন নূর হোসেনের বিরুদ্ধে। শনিবার সাক্ষ্য দিতে আসা এক ব্যক্তি জানান, চাঁদাবাজির জন্য নূর হোসেন একটি বাহিনী গঠন করেছেন। সেই বাহিনীর হাতে জিম্মি পুরো এলাকার লোকজন। তাদের সহযোগিতা করেছেন র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা। নূর হোসেন ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ র্যাব ও পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে উল্টো ফল হতো। সেখান থেকে নূর হোসেন ও তাঁর বাহিনীকে জানিয়ে দেওয়া হতো। নূর হোসেন এ পর্যন্ত ১০-১২ জনকে হত্যা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাতটির বেশি হত্যা মামলা রয়েছে। এর পরও নূর হোসেন এত দিন বহাল তবিয়তে ছিলেন।
আতঙ্কের নাম নূর হোসেন : সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার কলেজছাত্র রুমান হোসেন বলেন, ‘নূর হোসেন এখন এলাকায় নাই, তাই বলে শান্তি ফিরে আসেনি। তার লোকজন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে কারণে ভয়ের মধ্যে আছে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দারা। যত দিন নূর হোসেন গ্রেপ্তার না হবে, তত দিন এমন আতঙ্কে থাকতে হবে।’
গণশুনানিতে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন এক ব্যবসায়ী। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে বেশ ভয় পেতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে নূর হোসেনের এজেন্ট রয়েছে। আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এই খবর তারা নূর হোসেনের সহযোগীদের কাছে দিয়ে দিতে পারে। পাওয়ার হাউস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দেখা যাবে, গায়েব হয়ে গেছি। এ রকম গায়েব অনেকে হয়েছে, যার খবর কেউ রাখে না।’কাক