এনামুল মামুন, আজকের সময় বিনোদন ডেস্ক :
বেশ কিছুদিন ধরে জনপ্রিয় নাট্যকার মোশারফ করীমের মাইক নাটক নিয়ে বেশউত্তেজনা বিরাজ করছে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাবাসীদের সাইবার স্পেসে।ব্লগ-ফেসবুক এবং নিউজ সাইট গুলাতে তিব্র সমালোচনা হয়েছে। বিষয়টা অনেকে অনেকভাবে নিয়েছে- তাই আমি আজকে কিছু কাল্পনিক সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘মাইক’ নিয়ে আজকের কলাম শুরু করবো-
ঘটনা-এক
ফেনীর সোনাগাজীরতাকিয়া বাজার নামক স্থানে সূদুর দিনাজপুর থেকে রয়ান্স নামে এক রাজমিস্ত্রিএসেছেন। ফেনীতে শ্রমমূল্য দিনাজপুর থেকে বেশি হওয়াতে সে এখানে কাজ করতেএসেছেন। দীর্ঘদিন যাবত রয়ান্স মানুষের ঘরবাডী বোনার কাজ করে বেশ ভালোইউপার্জন করেছেন। তার নির্মাণ দক্ষতা দেখে অনেকে তাকে কাজ দেন। ফলে বিষয়টাএমন হয়েছে তার সততা এবং দক্ষতার জন্য তার উপার্জন জ্যামিতিক হারে বাডতেছে।এমন অবস্থা দেখে সেখানের ‘অনুষ্কার’ নামে এক পাতি সন্ত্রাসী তার কাছে চাঁদাদাবি করে।তাকে বলে ”তুমি এখানে কাজ করতে হলে আমাদেরকে প্রতি মাসেদুইহাজার টাকা করে দিতে হবে, না হয় তোমাকে কাজ করতে দেয়া হবেনা”। রয়ান্সবেশ কয় মাস সন্ত্রাসীদেরকে চাঁদা দিয়ে কাজ করছে। চাঁদা দেয়ার কারণ হলো তারস্থায়ী ঠিকানা ফেনী নই, দিনাজপুর। এখানে সে অসহায়! পরে উপার্জনের হিসাব নামিলাতে পেরে একদিন রাত্রে রয়ান্স দিনাজপুর চলে যায়।
ঘটনা-দুই
ইলমনামে এক মেধাবী ছাত্র- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পডালেখা করে। অনার্সে খুবভালো একটা বিষয়ে পডতেছে। তার অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে প্রায়ছয় বছরের বেশি। সেশনজটের কারণে এই এত বছর লেগেছে। যখন সে অনার্স সম্পন্নকরলো তখন তার বয়স হয়েছে ২৭ বছর। অনার্স শেষ করে অনেক চাকুরি সন্ধান করে।কিন্তু মিলাতে পারেনি একটা চাকুরি। অধিকাংশ চাকুরিতে ঘুষ দাবি করে। আবারবেতন আট থেকে দশ হাজার টাকা। এমন অবস্থা দেখে সে আর চাকুরির পেছনে ছুটেনি।সে সৌদি আরব গিয়ে দেশ থেকে বেশ ভালো টাকা উপার্জন করছে।
ঘটনা-তিন
ঢাকারমতিঝিল চত্বরের পাশে কোন এক ব্যাবসায়ী। ব্যাবসায়ীর নাম করিম। করিমের বাডীবরিশাল। এইচএসসি পাশ করে অনেকটা বেকার হয়ে গেলেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করারমতো তাদের টাকা ছিলোনা। পরে করিমের এক বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকা আসে। ঢাকা এসেসে অনেক কষ্ট করে একটা চা দোকান নেন। সেই ব্যাবসা ভালোই করতেছে। তারউপার্জন দিয়ে তার পরিবার বেশ সুন্দর ভাবেচলতেছে। হঠাৎ একদিন দেশের বডএকটি রাজনৈতিক দল হরতাল ডাকে। হরতালে ব্যাপক ভাঙ্গচুর হয়, এতে পাশের দোকানগুলাতে আগুন দরিয়ে দেই দলের নেতা কর্মীরা। এতে করে করিমের দোকানও আগুনেপুডে যায়। করিম দিশেহারা হয়ে এমন অবস্থা জন্য। সে এখন কি করে তার মা-বাবারজন্য টাকা পাঠাবে? তার আরেকটা দোকান দেয়ার মতো পূঁজি ছিলোনা, তাই সে আবারবরিশাল ছলে যায়।
ঘটনা-চার
ঢাকা শহরের বড একগার্মেন্টস। গার্মেন্টসটির নাম এক্সওয়াইজেডএফ ফ্যাশন। এখানে অনেক গুলিকর্মীকাজ করে। অধিকাংশ গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে। কর্মীগুলিসারাদিন পরিশ্রম করে। মাস শেষে মালিক তাদের মাইনে দিতে অনেক ঝামেলা করে।ফলে কর্মীগুলি তাদের গ্রামে্র বাডীতে টাকা পাঠাতে পারেননা। একদিন হঠাৎএক্সওয়াইজেডএফ গার্মেন্টসের মালিককেসেই এলাকার স্থানীয় এক নেতা বললেন- ”তোমার ফ্যাক্টরি থেকে কিছু কর্মী দিতে হবে, আগামীকালআমার একটা মিছিলআছে- সেখানে তুমি এটলিষ্ট ১০০ জন কর্মীদিতে হবেই”। মালিক এইকথা শুনে নম নমকন্ঠে বললেন- ”ওকে স্যার, ঠিক আছে”। পরের দিন মালিক তার ফ্যাক্টরির ১০০জন কর্মী তার মিছিলে পাঠালেন। যদি তিনি কর্মী না পাঠাতেন তাহলে তারপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিত সে।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি আমি বিভিন্ন কেইসস্টাডি করে লিখলাম। এইসব ঘটনার নাম এবং ঠিকানা সব কাল্পনিক, তবে এমন ঘটনাসত্য। এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।
এবার বলুন, মানুষ বিদেশ যাবেনাকি দেশে কিছু করবে?
এবার আসি মোশারফ করীমের ‘মাইক’ নাটক নিয়ে। আমি উপরোক্ত ঘটনা থেকে বিশ্লেষন করবো আজকের কলাম-
প্রথমতযে কথাটি বলতে হয়- ‘মাইক’ নাটকে প্রবাসীদেরকে যেভাবে তুচ্চ-তাচ্ছিল্য করাহয়েছে- তা নিতান্তই দুঃখ জনক। তবে এমনটা মোশারফ করীমের মতো একজন জনপ্রিয়নাট্যকার থেকে আমরা কখনো আশা করিনি। একটা নাটকে অনেকে জডিত থাকেন। আরস্ক্রিফ্ট রাইটারের মাথায় এমন চিন্তা কেন এসেছে তা ভাবার বিষয়। আর প্রযোজককি দেখেননি এই বিষয়টি। না কি তারা বুঝতে পারেননি? এমন অনেক হাজার প্রশ্নপ্রবাসী এবং তাদের স্বজনদের মনে।
বাংলাদেশে এমনি কোন ঘটনা ঘটলে তাতিলকে তাল বানানো হয়। তেমনি ‘মাইক’ নাটকটাও। তবে এটা সত্য যে- এই নাটক দিয়েপ্রবাসীদেরকে চরম ভাবে তুচ্চ-তাচ্ছিল্য এবং কটাক্ষ করেছেন, এটা ইচ্ছাকৃতহোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক।
অনেকে মনে করেন এই নাটক করা হয়েছে সৌদি আরবেযাওয়াকে নিরুৎসাহিত করার জন্য। আবার অনেকে বলে প্রবাসে যাওয়াকে নিরুৎসাহিতকরা উচিত, তবে তা অন্যভাবে করা হলে ভালো হতো।
এইতো মূল প্যাঁচহচ্ছে এইখানে।”প্রবাসে যাওয়াকে নিরুঃসাহিত করা” ।আমি নাটক সম্পর্কে আরকিছুই বলবোনা। তবে মানুষ প্রবাসী হওয়াকে যারা সমর্থন দিতে পারছেনা, বানিরুঃসাহিত করার কথা বলছেন- তাদের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে আমি প্রশ্নতুলতেপারি। তাদের যুক্তির মান নিয়ে আমাদের প্রশ্নতুলতে হয়।
মানুষ কেন প্রবাসে যাবেনা? প্রবাসে যাওয়াকে কেন নিরুৎসাহিত করা হবে তা আমার বোধগম্য আসছেনা।
আচ্ছা কেউ কি উপরোক্ত চারটি ঘটনাকে অস্বিকার করতে পারবেন? আপনি কি বলতে পারবেন এমন ঘটনা ঘটেনা?
আজব আমাদের সো-কলড সুশীল সমাজ। আজব তাদের শ্লিলের আডালে অশ্লিল মন্তব্য।
প্রবাসীদেরবিনোদনের প্রধান রসদ হচ্ছে বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং প্রচারিতনাটকগুলি। এই নাটকগুলি প্রবাসীরা দেখে তাদের বিনোদন চাহিদা পুরুন করে- এইজন্য স্যাটেলাই চ্যানেল গুলির মালিকের পকেটে মোটা হয়। প্রবাসীরা এইনাটকগুলি দেখার কারণে নাট্যকারদের বউকে দামি একটা শাডী কিনে দিতে পারছে। এইপ্রবাসীদের রক্ত প্রতিটা অনু-পরমানু মিশ্রিত রেমিটেন্সের কারণে দেশে এলিটপ্রজাতির নাগরিকের জন্ম হয়েছে। প্রবাসীদের দুঃখ মাখানো কয়েকফোঁটা ঘামেরবিনিময়ে আজকে দেশের অর্থনীতি চাকা সচল আছে। হিসাব মিলায় দেখেন, আমাদেরসমাজে যারা কোন রাজনৈতিক দলের ছায়ায় লোট-পাট করে, যখন দেশের একজন সন্ত্রাসীটেণ্ডাবাজি করে রাতা-রাতি ধনি হয় তাদের থেকে কি প্রবাসীরা অধিক উত্তম নই?? আজকে যদি প্রবাসীরা রেমিটেন্স না পাঠাতো দেশের কোন পন্ডিতের ‘মাইক’ ভাডাকরে বক্তব্য দেয়ার টাকা থাকতোনা। আমার লজ্জায় মাথায় হেট যায়- কেন প্রবাসেযাওয়াকে নিরুৎসাহিত করবে? যেখানে প্রবাসীদেরকে বিভিন্নভাবে মোটিভেট করারকথা। যেখানে প্রবাসীদেরকে ইন্সপাইরেশান দেয়ার কথা- সেখানে কেন উল্টোপ্রবাসীদের সোস্যাল রিসপেক্ট লাথি মেরে কেডে নিচ্ছে।
মানুষ কেনপ্রবাসে যাবেনা? উপরোক্ত আমি শুধু চারটি প্রেক্ষাপটের ফরমেট লিখলাম। এইরকমহাজারো ফরমেট বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে তৈরি করা সম্ভব। স্বাধীনবাংলাদেশের ৪৩ বছর পর আমি হলফ করে বলতে পারি- বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ দেশেকিছু করে ভালো অবস্থানে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব। তবে গুটি কয়েক সফল হয়। দেশেযখন তাদের প্রতিটা দরজা বন্ধ হয়ে যায়- তখন তারা মাতৃত্বের মায়ার বুকে বেঁধেপ্রবাসে পাডি জমায়। শুধু তার ছেলে-সন্তানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়ারজন্য। সেখানে প্রবাসে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা নিতান্তই অযৌক্তিক।