শুধু নামে-বেনামে প্লট নেওয়া নয়, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশও উপেক্ষা করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ২০১০ সালে স্বাবলম্বী কর্মজীবী নারীদের মধ্যে নির্ধারিত মূল্যে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ ছিল প্রধানমন্ত্রীর। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি চিঠিও পাঠানো হয় রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদাকে। একই সঙ্গে নারীদের প্লট পেতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে রাজউকের নীতিমালা সংশোধনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু নূরুল হুদা নীতিমালার ধারেকাছে না গিয়ে ওই চিঠি গোপন করে বরং কর্মজীবী যেসব নারী প্লট পেয়েছিলেন (১৯৯৯-২০০৫ সালে) তার বরাদ্দও বাতিল করেন। নারীর ক্ষমতায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার এ প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও প্রভাবশালী একটি অংশের যোগসাজশে পার পেয়ে যান সেই বিতর্কিত নূরুল হুদা।
এদিকে নূরুল হুদা প্রভাব খাটিয়ে রাজধানীর পূর্বাচলের ৯ নম্বর সেক্টরের ১০৩ নম্বর রোডে ১০ কাঠার ১৯ নম্বর প্লটটি নিজের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন, যা অন্যের নামে বরাদ্দ ছিল বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। ওই কমার্শিয়াল জমির বাজারমূল্য আট কোটি টাকা হলেও তিনি আবাসিক জমির মূল্য প্রদান করেছেন। আবাসিক জমি হিসেবে এর বাজারমূল্য ছিল তিন কোটি টাকা। শুধু নিজের প্রভাব খাটিয়ে নূরুল হুদা এ ধরনের অসৎ কাজ করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আবদুস সাত্তার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয় (স্মারক নং-প্রশা-৬/রাজ-১১/ ২০১০/)। চিঠিতে বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয়ে জানানো যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পত্রানুযায়ী বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতিসংঘ সনদ অনুসরণে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নার্থে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো : (ক) কর্মজীবী নারী, যার নিজস্ব আয় আছে, কর প্রদান করেন, তাদের প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ লাভের ক্ষেত্রে রাজউক/জাগৃক-এর নীতিমালা/হলফনামায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা এবং তার বাস্তবায়নপূর্বক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; (খ) পাশাপাশি প্লট/ফ্ল্যাটের জন্য আবেদনকারী পুরুষ নাগরিক, যার স্ত্রী কর্মজীবী, নিজস্ব আয় ও কর প্রদানক্ষম টিআইএনধারী, তার আবেদনের ক্ষেত্রে হলফনামার/নীতিমালায় উক্ত বিষয়টি প্রতিফলনপূর্বক সংশোধন করার পদক্ষেপ।
জানা গেছে, এ চিঠি নূরুল হুদার কাছে পাঠানো হলেও তিনি তা গোপন রাখেন। অন্তত আর ১২টি সংশ্লিষ্ট শাখায় চিঠিটি বিতরণ করতে বলা হয়। অত্যন্ত গোপনীয়তা কাজে লাগিয়ে তিনি চিঠিটি সংশ্লিষ্ট কোনো মহলেই পাঠাননি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অবহিত না করে নিজের মতো করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে যান নূরুল হুদা। সেখানেও কোটি কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯-২০০৫ সালে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেলিন শতাধিক নারী। কিন্তু তাদের বড় একটি অংশের বরাদ্দ বাতিল করে ২০১০ সালে নূরুল হুদা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেন, যার বাজারমূল্য ছিল অন্তত কোটি টাকা। সেখানে কোটি কোটি টাকা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন নারী আদালতে শরণাপন্ন হয়েও নূরুল হুদার দাপটের কাছে হেরে যান। এদিকে রাজধানীর উত্তরায় এনা প্রপার্টিজের প্লট-বাণিজ্য কেলেঙ্কারির সঙ্গেও সেই নূরুল হুদার এক ছেলের যোগসাজশ রয়েছে বলে সূত্র জানায়। ২০১০ সালে বরাদ্দ বাতিল হওয়া এক কর্মজীবী নারী রোকসানা জামান। একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। সরকারের সব শর্ত পূরণ করে নির্ধারিত মূল্যে তিনি প্লটের বরাদ্দ নেন। কিন্তু নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে তার বরাদ্দ পাওয়া প্লটটি বাতিল করে দেন নূরুল হুদা। পরে রোকসানা জামান এ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন। বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ওই সময় তার পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন। একপর্যায়ে ওই প্লট বাতিলের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেন আদালত। ওই স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় আইনের তোয়াক্কা না করে নূরুল হুদা তার ঘনিষ্ঠজনকে প্লটটি বরাদ্দ দেন। যাকে বরাদ্দ দেন তিনি প্লটটি তিন কোটি টাকার অধিক মূল্যে বিক্রি করে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হন। শুধু নিজস্ব লোকদের আর্থিকভাবে লাভবান করতেই প্লটগুলোর ন্যায়সংগত বরাদ্দ বাতিল করা হয়। একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল এক বিচারপতির সহধর্মিণীসহ অন্তত ৩০ জন নারী কর্মজীবীকে। তাদের বরাদ্দ পাওয়া প্লট থেকে বঞ্চিত করেন সেই নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী নূরুল হুদা। হলফনামা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্লট বাতিল করে দেন তিনি। আগের যে হলফনামার ভিত্তিতে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তিনি সেই হলফনামা পরিবর্তন করেন ২০১০ সালে। যেসব জমি ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই সময় যে হলফনামানা ছিল তা ২০১০ সালে তিনি পরিবর্তন করেন। রাজউকের বেশ কয়েকজন পরিচালক ও উপপরিচালকরা সব বরাদ্দ পাওয়া গ্রহীতাকে ২০১০ সালের হলফনামা সই করতে বাধ্য করেন। জমি বরাদ্দ ও কিস্তি পরিশোধের পর কোনো আইনেই নূরুল হুদা এ ধরনের হলফনামা চাইতে পারেন না। এটি সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়াও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দ্বিতীয়বার হলফনামাগুলো চাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুধু জমিগুলোর বরাদ্দ বাতিল করে নিজ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়ার জন্যই নূরুল হুদা এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্লটহারা কর্মজীবী নারীরা বলছেন, বর্তমান পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ১৯৯৯ সালে একই পদে থাকাকালে ওই হলফনামা তৈরি করেন। সে অনুযায়ী শতাধিক নারী ওই সময় প্লট বরাদ্দ পান। এখনো মন্ত্রী একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। প্লটহারা নারীরা আশা করছেন, নূরুল হুদার ওই ‘অবৈধ’ হলফনামার আদেশটি বাতিল করে আগের মতোই কর্মজীবী নারীদের নিজ নিজ প্লট বরাদ্দ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বা প্র