শেষ পর্যন্ত অনেকটা বিনা বাধায় উন্মুক্ত হয়ে গেল বাংলাদেশে ভারতীয় ছবির বাজার। চলতি মাসে যৌথ প্রযোজনার নামে একটি এবং আমদানির নামে একটি, মোট দুটি ভারতীয় ছবি অবাধে বাংলাদেশের অসংখ্য প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবি দুটি হলো ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ এবং ‘যুদ্ধশিশু’। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ নির্মাণ হয়েছে পশ্চিমবাংলার এসকে প্রোডাকশন এবং ঢাকার অ্যাকশন-কাট এন্টারটেইনমেন্টের যৌথ প্রযোজনায়। ছবিটি নির্মাণ করেছেন ঢাকার অনন্য মামুন ও কলকাতার অশোক পতি। এ ছবিটি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার নামে একটি সংগঠন প্রবল বিরোধিতা করলেও সেন্সর বোর্ডের সনদপত্র, চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির অনুমোদন, সর্বোপরি আদালতের রায় নিয়ে এটি প্রায় ৭০টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। ২৩শে মে শুক্রবার থেকে ঢাকার আরও ৫০টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন হবে। এ বিষয়েও আদালতের রায় অনন্য মামুনের হাতে। ছবির ভারতীয় প্রযোজক অশোক ধানুকা এখন ঢাকায়। ছবির সাফল্যে তিনি যথেষ্ট খুশি। বলেন, ভাল ছবি হলে সেটা সব জায়গাতেই ভাল চলবে। কলকাতাতেও ছবিটি ভাল চলছে। আরেক ছবি ‘যুদ্ধশিশু’। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বর্বরতার কিছু চিত্র নিয়ে নির্মিত ভারতীয় ছবি ‘চিলড্রেন অব ওয়ার- নাইন মান্থ টু ফ্রিডম- যুদ্ধশিশু’। ঢাকাসহ সারা দেশের এক ডজনেরও বেশি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়ে ছবিটি প্রশংসিত হয়েছে। দুটি ভারতীয় ছবির মধ্যে কলকাতার শুভশ্রী-অংকুশ এবং ঢাকার মিশা সওদাগর ও ডন অভিনীত ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ দুর্দান্ত ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করেছে। প্রেক্ষাগৃহের মালিক এবং তাদের প্রতিনিধি বুকিং এজেন্টরা এ ছবির ব্যবসায় দারুণভাবে খুশি। তাদের কথা, সমপ্রতি শাকিব খান অভিনীত দুটি বড় ছবি ‘ডেয়ারিং লাভার’ ও ‘ভালবাসা এক্সপ্রেস’ প্রদর্শন করে প্রেক্ষাগৃহগুলোকে ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ দিয়ে প্রেক্ষাগৃহগুলো সেই ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখছে। এ ধরনের ভাল মানের ছবি বাংলাদেশে প্রদর্শিত হলে দেশের চলচ্চিত্র ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠবে, শিল্পটাও বাঁচবে। ‘যুদ্ধশিশু’ সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের মন্তব্য, এটিও একটি ভাল ছবি। নতুন প্রজন্ম এই ছবি দেখে প্রশংসা করছে। দেশে নির্মিত ডিজিটালের নামে ভিডিও ফিল্ম থেকে এই ছবি অনেক ভাল। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের বক্তব্য এবং ভারতীয় ভাল মানের ছবির প্রতি তাদের সমর্থন থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় ছবির বাজার উন্মুক্ত হোক এমনটাই তারা চান। কারণ, বিগত সময়ে ভারতীয় তিনটি বাংলা ছবি ‘জোর’, ‘বদলা’ এবং ‘সংগ্রাম’ এবং যৌথ প্রযোজনার দুটি ছবি ‘বাংলার পাগলু’ ও ‘সীমারেখা’ দর্শক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তারা ভারতীয় ছবির বিষয়ে আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবির সাফল্যে তারাই শুধু অনুপ্রাণিত নন, অনুপ্রাণিত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও। ‘যুদ্ধশিশু’ ছবির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খান ব্রাদার্স ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুসারে রপ্তানির বিপরীতে ছবি আমদানি শুরু করে দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গেজেটে প্রকাশিত নীতিমালায় রয়েছে, ‘রপ্তানির বিপরীতে সাফটাভুক্ত দেশ থেকে সমান সংখ্যক চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শন করা যাইবে।’ এই গেজেট অনুসারে খান ব্রাদার্স সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত শাকিব খান ও ইরিন অভিনীত ‘অনন্ত ভালবাসা’ এবং জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস অভিনীত ‘মা আমার স্বর্গ’ ছবি দুটি ভারতে রপ্তানি করে তার বিপরীতে দেব অভিনীত ‘খোকাবাবু’ এবং ‘খোকাবাবু ৪২০’ ছবি দুটি আমদানি করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছে। এখন ছবি দুটি ছাড়পত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনা বাধায় বাংলাদেশে মুক্তি পেয়ে যাবে। অপরদিকে পূর্বের তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি ‘জোর’, ‘বদলা’ ও ‘সংগ্রাম’-এর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনউইন এন্টারপ্রাইজ ভারতীয় ৯টি হিন্দি ছবি আমদানি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বের গেজেট অনুসারে। ছবিগুলো দীর্ঘদিন বিমানবন্দর কাস্টমসে আটকে থাকার পর একটি ছবি সালমান খান অভিনীত ‘ওয়ান্টেড’ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা পড়েছে। এ ছবিটিও যদি বাংলাদেশে অবাধ প্রদর্শনের জন্য ছাড়পত্র পেয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় হিন্দি-বাংলাসহ সাফটাভুক্ত দেশগুলোর সিনেমা প্রদর্শনে আর কোন বাধা থাকবে না। এতে চলচ্চিত্র শিল্পের বাসিন্দারা স্পষ্টভাবেই ধরে নিয়েছেন, দীর্ঘ ৪০ বছর পর এ দেশে ভারতীয় ছবির বাজার প্রায় উন্মুক্ত হয়ে গেল। বিশ্বায়ন আর আকাশ সংস্কৃতির যুগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে এখন প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হবে। এটা একদিক দিয়ে ভাল যে, প্রতিযোগিতামূলক ছবি নির্মাণ হলে এ দেশের ছবির মান ভাল হবে। আরেকটি ভাল দিক হলো, বর্তমানে ডিজিটালের নামে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে তার হাত থেকে চলচ্চিত্র শিল্প, দর্শক প্রদর্শক মুক্তি পাবে। মন্দ দিক হচ্ছে, ভারতীয় ছবির বিশ্ববাজার রয়েছে। বাংলাদেশের তা নেই। ভারতীয় ছবির বড় বাজেট রয়েছে, উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে, বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের তা নেই। অসম প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প টিকবে না এটা দিনের আলোর মতো সত্য। এখন কি করা উচিত, কি করতে হবে, কিভাবে কি করলে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প বাঁচবে এটা দেখার দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার। এ বিষয়ে সরকার ও চলচ্চিত্র শিল্পের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে সেই নীতিমালা পুরোপুরি মেনে সিনেমা নির্মাণ, আমদানি, রপ্তানি এবং প্রদর্শন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প শুধু বাঁচবেই না, তার হারানো ঐতিহ্য আর গৌরব ফিরে পাবে। মানবজমিন