রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও মধ্যবিত্তের অবস্থান

peopleআবুল হাসানাত : শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্ত এক নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। বর্তমানের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সুস্থ চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ, সুখী সমাজ গড়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না, যদি না এই তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নামধারী মতবাদের বিরাট পরিবর্তন সম্পন্ন করে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়া না যায়। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এখন একটি ঝুট মতবাদে পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের লেবাস পরে যে কা-কারখানা চলছে, যে আইন-শাসন চলছে, যে অপহরণ-গুম-হত্যার আঁচড় লেগে গেছে তাতে মধ্যবিত্তরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা টিকতে পারবে কি না সন্দেহ। উপরন্তু যে অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে তাদের বিদ্যুৎ-পানির খরচ বহন করতে হচ্ছে তাও ভয়াবহ আর্থিক চাপের মধ্যে রেখেছে এ মধ্যবিত্ত সমাজকে।
আমাদের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, প্রশাসনে আইনের প্রয়োগ, আইনের মান্যতা, সুস্থ চিন্তা-চেতনা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে ও লুটেরা শাসকশ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশে একেবারে তছনছ হয়ে গেল। লুট, ব্যাংক লুট, জালিয়াতি, চোরাকারবারি, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুম ইত্যাদির বাড়বাড়ন্তে সমাজের গঠন ও সামাজিক ভিত্তিটাই নড়ে গেল। সামাজিক অস্থিরতায় ব্যক্তি-জীবন সুস্থির ও সুস্থ থাকতে পারল না। লুটেরা শাসকশ্রেণি ও তাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অসাধু শিল্পপতি, ব্যবসায়ী উচ্চ শ্রেণির ডালে বসে মহানন্দে কা কা রব তুলল। এরা আইনের ঊধর্্েব। বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। ১৯৭১ থেকে আজতক এ শ্রেণির বৃদ্ধি এমন অস্বাভাবিক গতিতে ধাবিত যে এদের নিচে যে শ্রেণি রয়েছেথ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত, তাদের আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থান নিম্নগামী এবং পতনোন্মুখ। এরা না পারে ওপরে উঠতে, না পারে নিচে নামতে। ত্রিশঙ্কু অবস্থা। কিন্তু বাসনার পাখা মেলতে অসুবিধা কী। সাধের অন্ত নেই, কিন্তু সাধ্য নেই। চাকরি ও ছোটখাটো ব্যবসা এদের সম্বল। ঘুষের একটা ভালো বাজার আছে। কিন্তু এরা যে ধরনের চাকরি করে তাতে এর স্বর্ণডিম্বের পোচ খাওয়া সম্ভব নয়। প্রায় আদর্শবাদী, নীতিবাদী ভীরু এবং সুবিধাবাদী এই শ্রেণির সামনে সূর্যরশ্মিস্নাত দিনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এ দেশে মধ্যবিত্তের প্রধান সমস্যা আয় থেকে ব্যয় বেশি। অধিকাংশ চাকরিজীবী যে বেতন পান তা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। এটা একটা ভীষণ সমস্যা। তাজ্জব ব্যাপার হলো খাদ্যদ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা সম্পর্কে সরকার উদাসীন। ব্যবসায়ী, আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতা, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতা জিনিসপত্রের দামের ব্যাপারে যে লাগামছাড়া ব্যবস্থা নেয়, তা বিক্রেতার পক্ষে বহুল লাভজনক, ক্রেতার পক্ষে নয়। গত পাঁচ বছরে ভোক্তারা যে দাম দিচ্ছেন তা তো কয়েক গুণ বেশি, যা ২০০৭-০৮-এ ছিল না। সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পারবে কীভাবে, সদিচ্ছা তো নেই। তা ছাড়া ভোক্তাশ্রেণি তথা জনসাধারণ এতই অসংঘবদ্ধ যে তাদের কোনো আওয়াজও নেই। শ্রমিক থেকে কৃষক আওয়াজ দেয়থ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সরকারের ওপর চাপ দিয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকে, কিন্তু ভোক্তাশ্রেণি একেবারে নির্বিকার, হতাশাবাদী ও আন্দোলনবিমুখ। আজকের ঘটনা বলিথ কয়েক দিন আগে মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছিল ৭৮ টাকা ডজন, আজ দেখি ৯০ টাকা ডজন। দোকানদার বলতে পারেন কেন বাড়ল। সরবরাহকারী বললেন, বেড়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণ করে কারওয়ান বাজার। আমি অসহায়, ওই দামে কিনে নিলাম। এভাবেই নিষ্ক্রিয়তা, অসহায়তা লক্ষ্য করা যায়।
মধ্যবিত্তের অসহায়তা কেবল এ ক্ষেত্রেই নয়, বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রেও। লাফিয়ে লাফিয়ে যে প্রতি বছর বা প্রতি দুই বছর অন্তর বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়, তা তো ভাড়াটিয়াদের পক্ষে খুবই অসুবিধার সৃষ্টি করে। তারা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় কিংবা ভাড়া বৃদ্ধির অঙ্কটা মেনে নেয়। এ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের পক্ষে আইন খুব দুর্বল। অথচ পাশের দেশ কলকাতায় আইন ভাড়াটিয়াদের পক্ষে। ইচ্ছা হলেই উঠানো যায় না। সুস্পষ্ট সঙ্গত কারণ দেখাতে হয়। স্মরণ করি একটা ঘটনা। বুদ্ধদেব বসু একটি ভাড়া বাড়িতে প্রায় ৩০ বছর বসবাস করেছিলেন।
আরেকটি সমস্যা মধ্যবিত্তের। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ। এটি যে ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে তা প্রত্যেক মা-বাবা-অভিভাবক হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। লেখাপড়ার খরচ এত বেশি যে তার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। লক্ষণীয়, ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-কিন্ডারগার্টেন গজিয়ে উঠছে। স্বাভাবিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত আর সীমাহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। এখনকার অবস্থা ব্যবসা, লাভজনক ব্যবসাথ আর দশটা পকেট কাটার যেসব ব্যবসা আছে তার সঙ্গে এদের মিল রয়েছে। আকাশচুম্বী বেতন, ভর্তি ফি, আনুষঙ্গিক আরো ফি সব মিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ যা নেয়, তাতে কোনো অভিভাবকই মনে করেন না তারা ন্যায়সঙ্গত টাকা নিচ্ছেন, পকেট কাটছেন না। মুশকিল হচ্ছে এসব বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকদের ভর্তি না করা ছাড়া গত্যন্তর নেই, কারণ সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের সঙ্গে মেলাতে গেলে দেখা যায় খুব কম। সেই স্বল্পতার কারণে বেসরকারি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অর্থলগ্নি যারা করছেন তারা লাভের জন্য করছেন। ব্যবসা যখন তখন লাভ তো চাই-ই; কিন্তু ‘গাঁট কাটা’। অবস্থার এসব কারণে, মধ্যবিত্তের সন্তানদের একটি বিরাট অংশ স্কুলের পরই ঝরে পড়ে। কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। এই যে বিরাটসংখ্যক কিশোর, তারা কী করবে? তাদের কোনো ব্যবস্থা সরকার করেছে কি?
এ দেশের মধ্যবিত্তের সমস্যাটি জীবনের সামগ্রিকতা ঘিরে। ধরুন যাতায়াতের বিষয়। যাতায়াত খরচ এত বেশি, যাতায়াতব্যবস্থা এত খারাপ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকাংশ অভিভাবকের বাড়তি খরচ বহন করতে হয়; যেমন হেঁটে যাওয়া সম্ভব হয় না বলে বাসে, বাসে চড়া সম্ভব হয় না বলে রিকশায়। কিন্তু রিকশা খরচ বহন করার ক্ষমতা কতজন অভিভাবকের আছে। তবুও মধ্যবিত্ত তার সর্বশক্তি দিয়ে পুত্র-কন্যাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারণ, এ ছাড়া গতি নেই। তারা জানে শিক্ষিত না হলে তাদের সন্তানেরা চাকরি পাবে নাথ অফিস-আদালত হোক, কী স্কুল-কলেজ হোক, কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ইনশিওরেন্স, চ্যানেলে। সর্বত্র প্রতিযোগিতা এবং বলাবাহুল্য পদসংখ্যা সীমিত। উপরন্তু চাকরি যে হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ চাচা-মামার জোর না থাকলে চাকরি হয় না। অনেক অফিসে ঘুষ দিতে হয় চাকরির জন্য এবং এটা দু-এক হাজার নয়, লাখ লাখ। কজন পিতা-মাতা তা পারবেন। বোধহয় বাস্তবতার এ ভয়াবহ অবস্থা উপলব্ধি করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র ফ্রন্টের নেতা হয় বা সদস্য এবং বলাবাহুল্য যারা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সদস্যথ তারা চাঁদাবাজি ও ভর্তিবাণিজ্য প্রভৃতি অনৈতিক ও বে আইনি কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে।
আগেই বলেছি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সামাজিক ভিতটা ভেঙে গেছে। মানুষের যা কিছু সহ্য দিক, আদর্শের দিক, মূল্যবোধের দিক তা ভেঙে গেছে। লোপ পেয়েছে সত্যতা, সততা ও আদর্শবোধ। ভয়াবহ একটি দুর্নীতির চাদর সমাজকে গ্রাস করেছে। এ অবস্থায় উচ্চ শ্রেণির টিকে থাকার সুযোগ আছে। মধ্যবিত্তের নেই। অবশ্য মধ্যবিত্তের সামান্য অংশ ওপরে ওঠে না তা নয়, ওঠে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে, দুর্নীতিতে জড়িয়ে। বাদবাকি কোনোরকমে টিকে থাকে এবং একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্ততে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্ত এক নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। বর্তমানের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সুস্থ চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ, সুখী সমাজ গড়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না, যদি না এই তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নামধারী মতবাদের বিরাট পরিবর্তন সম্পন্ন করে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়া না যায়। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এখন একটি ঝুট মতবাদে পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের লেবাস পরে যে কা-কারখানা চলছে, যে আইন-শাসন চলছে, যে অপহরণ-গুম-হত্যার আঁচড় লেগে গেছে তাতে মধ্যবিত্তরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা টিকতে পারবে কি না সন্দেহ। উপরন্তু যে অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে তাদের বিদ্যুৎ-পানির খরচ বহন করতে হচ্ছে তাও ভয়াবহ আর্থিক চাপের মধ্যে রেখেছে এ মধ্যবিত্ত সমাজকে।
এ দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের অবস্থা ওইরূপ হওয়ায় সমাজে তাদের অবস্থান নড়বড়ে, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই বললেই চলে। মধ্যবিত্ত সমাজের যারা গানবাজনা করেন, অভিনয় করেন, নাটক করেন তারা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করে থাকেন, পুরস্কার পান, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পান তাদের আর যাই হোক আর্থিক অবস্থা উল্লেখ করার মতো নয়। আর যেসব লেখক লেখেন তারা তাদের রচনার জন্য পারিশ্রমিক পান কি না সন্দেহথ গালভারী নাম রয়্যালটি বা সম্মানি। তাই প্রকৃত সত্য, মধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশকে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। যাযাদি
আবুল হাসানাত: গবেষক ও কথাশিল্পী  আ স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *