একরাম কিলিং মিশনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৪ জন!

image_82897_0ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যার ঘটনায় জড়িত খুনিদের মধ্যে অন্তত চারজন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত মুখ। এই চারজন হলেন- আবিদ, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, জিয়াউল হক মিস্টার এবং সোহেল।

বুধবার ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঘটনার বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ফেনীর আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে একরামুল হক হত্যাকাণ্ডে ওই চার ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে এই তথ্য কতটা সঠিক, তা যাচাই করতে পারেনি পত্রিকাটি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন- হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সম্ভাব্য ওই চারজনের মধ্যে আবিদ হলেন সম্পর্কে ফেনী-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদ্দস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ভাই, জাহিদ হলেন ফুলগাজী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সচিব, জিয়াউল হলেন ফেনী পৌরসভার যুবলীগ নেতা এবং সোহেল হলেন স্থানীয় একজন ক্যাডার।

একরামুলের ওপর হামলাকারী ৩০-৩৫ জনের দলটির নেতৃত্ব এই চারজনই দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

মঙ্গলবার আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে ফেনীর একটি সড়কে হামলাকারীদের দলটি প্রথমে একরামুলের বুকে গুলি করে এবং পরে তার গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে পুড়িয়ে দেয়। মর্মান্তিক এই ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান একরামুল।

এ সময় ‘ভাড়া করা পেশাদার খুনি’ ও হামলাকারী দলটি স্থানীয় এক সাংবাদিক ও একরামুলের গাড়িচালকসহ আরো চারজনকে পিটিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে।

পুলিশ এখনো হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণও উদঘাটন করতে পারেনি। কিন্তু ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ স্থানীয় লোকজন সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছে।

তবে মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো বিষয় হলো, একরামুল হক হত্যার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্যদের দায়ের করা মামলায় মূল অভিযুক্ত আসামি হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর।

গত মার্চ মাসে ফুলগাজী চেয়ারম্যান পদে একরামুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন মাহতাব। তবে মোট ছয় দফায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেশব্যাপী যে সহিংসতা, ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলসহ বিভিন্ন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনেও। একরকম জোর করেই সে সময় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছিলেন একরামুল হক এবং নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেই মাহতাবসহ অন্যান্য চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের হারিয়েছিলেন তিনি।

মাহতাব এবং নাম উল্লেখ না করা অজ্ঞাত আরো ৩৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় কী উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন নিহত একরামের ভাই জিয়াউল হক সেলিম। তিনি বলেন, “আমার ছোট ভাই মামলাটি দায়ের করেছে। আর শুধু আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমরা জানি না মামলায় কাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”

তার ছোট ভাই রিয়াজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই মামলায় মাহতাবের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত ছিল না।”

এক সময় নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এই একরামুল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই নিজাম হাজারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যান একরামুল। ফেনী-২ আসন থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশের নীতি-নির্ধারক হিসেবে সংসদে আসীন হন নিজাম হাজারী।

স্থানীয় এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, নিজামের চাপে পড়েই পরে সংসদ নির্বাচনের লড়াই থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন একরামুল।

তবে নিজাম হাজারী এবং একরামুল হকের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় মূলত জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন খাতে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ ও জোরপূর্বক দরপত্রের কাজ পাওয়াকে কেন্দ্র করে।

উচ্চ আদালতে জাল দলিল জমা দেয়ার মাধ্যমে নিজাম হাজারীর অবৈধভাবে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার প্রমাণ হিসেবে বেশকিছু নথিপত্র সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অভিযোগে চলতি মাসের শুরুতে একরামের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন নিজাম হাজারী।

গত ১০ মে দেশের প্রথম সারির দুই বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও মানবজমিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০ সালের আগস্ট মাসে অস্ত্র মামলায় নিজাম হাজারীর ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ হয়েছিল। কিন্তু সাজাভোগের পাঁচ বছরও কাটতে না কাটতেই জালিয়াতির মাধ্যমে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রামের একটি কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

ফেনীর সদরের কয়েকজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা জানান, এসব তথ্য ফাঁস হওয়ার জন্য একরামকের দোষ দিয়েছিলেন নিজাম হাজারী।

এই সমস্যার সমাধানে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ মে তাদের গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন- এই খবরটিও ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এই দুজনের মধ্যে তিক্ততা মারাত্মক আকার ধারণ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেবার চেষ্টা করলেও এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

তবে নিজাম হাজারী ছাড়াও আরো অনেককেই নিজের শত্রুতে পরিণত করেছিলেন একরাম। তাদেরই একজন হলেন জাহিদ, যিনি একরাম হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের অন্যতম। জাহিদ উপজেলা নির্বাচনে ফুলগাজী থেকে চেয়ারম্যান পদে লড়াই করলেও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী একরামুলের কাছে পরাজিত হন।

ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরাম এমনকি পরে জাহিদকে দল থেকেও বহিষ্কার করেন। কিন্তু সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর হস্তক্ষেপে পরে জাহিদের ওপর থেকে দল বহিষ্কারাদেশ উঠিয়ে নেয়।

এরপর আসে হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগে উঠে আসা আরেক ব্যক্তি সোহেলের নাম। জানা যায়, সোহেল একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শিবলুর ছত্রছায়ায় থেকে সোহেল একজন দুর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হন।

যে স্থানে একরামুলকে হত্যা করা হয়েছে, সেই বিলাসী সিনেমা হল এলাকা শিবলু নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানান স্থানীয়রা। তারা আরো জানান, এই শিবলুই হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন।

এরপর একরামুল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে আসা চতুর্থ নাম হলো জিয়াউল, যিনি ফেনী উপজেলা নির্বাচনের সময়েও একরামের ওপর হামলা করেছিলেন।

স্থানীয়দের অভিযোগে উঠে আসা এই চারজন ব্যক্তির নাম জানার পর এই বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

ফোনে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনিও ফোন ধরেননি। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন সে সম্পর্কেও তার পরিবারের সদস্যরা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।

ফুলগাজীতে একরামের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বুধবার নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেন স্থানীয়রা। স্লোগানে নিজাম হাজারীই হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রান্তকারী বলে দাবি করেন তারা।

মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ বৃহস্পতিবার হরতাল পালন করছে।

এদিকে, মঙ্গলবার রাতে মামলার সঙ্গে জড়িত হিসেবে পুলিশ ১৫ জনকে আটক করেছে এবং ফেনী সদর থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও দুটি মোটর সাইকেল জব্দ করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটর সাইকেল দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে।

আটককৃতদের অধিকাংশই ফুটপাত ও সড়কের ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা, হকার, রিকশাচালক এবং হোটেলের কর্মচারী। তাদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।

তাদের কেন আটক করা হয়েছে জানতে চাওয়া হলে ফেনী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মাহবুব মোর্শেদ জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুব শিগগিরই চিহ্নিত করা হবে বলে আশা করছি আমরা।” সূত্র: ডেইলি স্টার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *