॥ এল নিনোর দাপটে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ॥ মৌসুমী বায়ু প্রবাহে বাধা ট॥ গ্রীষ্মের খরা বর্ষায়ও প্রভাব ফেলবে ॥
পাঁচ বছর পর আবারও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এল নিনোর প্রভাবে আক্রান্ত জলবায়ু। এর প্রভাবে বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এবার নেতিবাচক আচরণ করতে পারে। ইতোমধ্যে প্রাক-বর্ষা অর্থাৎ গ্রীষ্মজুড়ে খরা এবং তীব্র তাপপ্রবাহে বিস্তৃত ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ২০০৯ সালের এল নিনোর প্রভাবে মারাত্মক খরা সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর ভারত মহাসাগরীয় উপকূলীয় এবং হিমালয়ের পাদদেশে। ওই বছর ২১ ভাগ বৃষ্টি হ্রাস পেয়েছিল। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ে। পাঁচ বছর পর আবারও এল নিনোর মারাত্মক প্রভাবের আশঙ্কা করছে ইউএস ন্যাশনাল ওশানিক এ্যান্ড এটমোশফেরিক এডমিনিস্ট্রেশন এবং অস্ট্রেলিয়ান মেট্রোলজিক্যাল ব্যুরো। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ু নিয়ে গবেষণারত আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে জানিয়েছে, গ্রীষ্মে মারাত্মক তাপপ্রবাহের পর আগামী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু তথা বর্ষাতেও এর প্রভাব পড়বে। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে সাগরের উপর স্তরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এল নিনোর প্রভাবকে।
আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বিভিন্ন আভাসে বলা হয়েছে, এল নিনোর প্রভাবে ভারত এবং বাংলাদেশ এবার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দুর্বল থাকবে। মধ্য এপ্রিল থেকে এর প্রভাব শুরু হওয়ায় আগামী জুন থেকে মূল বর্ষা মৌসুমে এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে। ইউএস ন্যাশনাল ওশানিক এ্যান্ড এটমোশফেরিক এডমিনিস্ট্রেশন মন্তব্য করেছে, এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় এল নিনোর প্রভাব থাকবে ৫০ ভাগ। আর অস্ট্রেলিয়ান মেট্রোলজিক্যাল ব্যুরোর রিপোর্টে বলা হয়েছে- এর প্রভাব থাকবে ৭০ ভাগ। ২০০৯ সালে এল নিনোর প্রভাবে মারাত্মক খরা সৃষ্টি হয়েছিল এ অঞ্চলে। ২০০৪ সালেও একইভাবে এল নিনোর প্রভাবে খরা ছিল। ২০০৯ সালে ২১ ভাগ বৃষ্টিপাত হ্রাস হলেও ২০০৪ সালে তা ছিল ১২ ভাগ কম। পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এল নিনোর প্রভাবে জলবায়ুতে পরিবর্তন আসছে। সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী ১২৬ বছরের ইতিহাসে (১৮৮০-২০০৫) বৃষ্টিপাত কম হওয়ার বছরগুলোতে ৯০ ভাগই এল নিনোর প্রভাব ছিল। একই সময়ের মধ্যে ৬৫ ভাগ খরার কারণ ছিল ওই এল নিনো। সাধারণত এল নিনোর প্রভাব থাকলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকে। গত ১৮০১ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২১০ বছরের ইতিহাসে এল নিনোর প্রভাবে মোট ৪৩ বছর বৃষ্টিপাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গবেষণা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী স্প্যানিশ শব্দ লিটল বয় অর্থাৎ এল নিনো প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের পানির তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাংলাদেশ-ভারত উপকূলীয় এলাকায় প্রভাব ফেলে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে। আর মৌসুমি বায়ুপ্রবাহকে সক্রিয় করতে প্রভাব বিস্তার করে ঠিক উল্টো দিক থেকে প্রবাহিত লা লিনা। দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চল থেকে সাগরের উপরিভাগে তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল লা লিনা। স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস উপরিভাগের তাপমাত্রা বাড়লে লা লিনা প্রভাব বিস্তার করে। এর কারণে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে প্রভাব পড়ে। যার প্রভাবে ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টির প্রভাব বেড়ে যায়। গত দশ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ সালে সবচেয়ে বেশি লা লিনার প্রভাব ছিল। ওই বছর দশ ভাগ বৃষ্টিপাত বেশি হয়। ১০ জুন চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণ ঘটেছিল। লা লিনার প্রভাব থাকায় ২০০৫, ২০০৬, ২০১০, ২০১১ সালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে সামান্য বেশি বৃষ্টিপাত ছিল। গত বছরও লা লিনার প্রভাবে ৬ ভাগ অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়। কয়েক বছর পর পর এল নিনোর প্রভাব ঘটে। এ বছরও আবার এল লিনার প্রভাব হলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাবে। গ্রীষ্ম থেকে এর প্রভাব শুরু হওয়ায় আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এর প্রভাব দেখা যেতে পারে ভারত-বাংলাদেশজুড়ে। ফলে বর্ষা মৌসুমে ফসল উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে চাল, আখ ও সরিষা উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে।
মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে এল নিনোর প্রভাব থাকলেও এবার নির্ধারিত সময়ের দুই-তিন দিন আগেই মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বঙ্গোপসাগর অভিমুখে পৌঁছে যাবে। আগামী ২৬ মে উত্তর ভারত মহাসাগর পেরিয়ে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ আন্দামান সাগরে প্রবেশ করবে। এর পরবর্তীতে এটি বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর এবং কেরালার দিকে বিস্তৃতি ঘটবে। ভারতীয় আবহাওয়া সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী এবার মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ নির্ধারিত সময়ের দুই-তিন দিন আগে পৌঁছে যাবে। সাধারণত ৩০ মের মধ্যে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত হবে। এবার সামান্য আগে পৌঁছে গেলেও এল নিনোর প্রভাবে বৃষ্টিপাতে প্রভাব ফেলবে।