বেসিক ব্যাংকের অনিয়মে বিব্রত সরকার

4_7927

বেসিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে সরকারে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা যা খুশি তা করছে। অবিলম্বে এ শাখা বন্ধ করে দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, সোনালী ব্যাংকের পর এখন আরেকটি ব্যাংক বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। আর তা হলো বেসিক ব্যাংক। জানা গেছে, শুধু অর্থমন্ত্রীই নন, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলও বেসিক ব্যাংক নিয়ে বিব্রত। বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখায় ভুয়া ঋণের ছড়াছড়ি। এ শাখার ঋণের বিপরীতে জমির যেসব দলিল বন্ধক রয়েছে তার অধিকাংশ ভুয়া, যা শুধু কাগজে-কলমে রয়েছে। বাস্তবে এর কোনো মিল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলে সবকিছু বেরিয়ে আসবে। সংশ্লিষ্টদের মতে এ ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণই রাজনৈতিক। এ জন্য বেসিক ব্যাংকের ঋণ কোনো দিন ফেরত পাওয়া যাবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঋণের টাকা ভাগাভাগি করা; অস্তিত্বহীন ভুয়া কাগুজে, বেনামি ও কর্মচারীদের নামে তৈরি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া; ঋণ ছাড়ের সময় কোনো শর্ত পালন না করাই হচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও ঋণগ্রহীতাদের নিত্যদিনের কাজ। এমনকি ঋণ হিসাবের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও সুদ চার্জ করে তাকে আয় দেখানো, নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে পুনঃ তফসিলিকরণ ছাড়াই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে খেলাপি না দেখানো এবং বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে ও ভিন্ন খাতে ব্যবহারও করেছেন ঋণগ্রহীতারা। এসব অপকর্ম ও অনিয়ম করতে স্বয়ং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জালিয়াত চক্রকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আর এসব অনিয়মের মূলে রয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। সন্দেহের তালিকায় খোদ চেয়ারম্যানও রয়েছেন।

জানা গেছে, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মামা-ভাগ্নে। এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে ও ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছেন তারা। উভয় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে অনীহা দেখিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধ অমান্য করে ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের প্রস্তাবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ৬০ কোটি টাকার এসওডি ঋণ অনুমোদন করে। একইভাবে এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের প্রস্তাবে ৫০ কোটি টাকার এসওডি, ১০ কোটি টাকার এলসি বা ঋণপত্র (পিএডি বা রপ্তানি দলিলাদিও বিপরীতে অগ্রিম) ও ৫ কোটি টাকার এলটিআর (বিশ্বাসের ঋণ) অনুমোদন করে। পরবর্তীতে গুলশান শাখার একই দিনের প্রস্তাবে পরিচালনা পর্ষদ ওই দিনই এসওডি ৯৫ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে। এসওডি হলো এক ধরনের ঋণ, যার বিপরীতে ১০০ ভাগ নগদায়নের মতো অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর জাতীয় জামানত থাকার কথা। বেসিক ব্যাংক এসব জামানত না নিয়ে তার ব্যবসায়িক পণ্যের বিপরীতে এসওডি ঋণ দিয়েছে। এ ঋণের কোনো অর্থ ফেরত বা জমা না পড়লেও ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকার সুদ আয় দেখিয়েছে ব্যাংকটি, যা রীতিমতো ব্যাংকিং আইনবহির্ভূত। এতে বিস্মিত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিকে এসব আগ্রাসী ব্যাংকিং ও অনিয়ম জালিয়াতির ব্যাপারে একাধিকবার সতর্কও করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা কোনোভাবেই আমলে নেয়নি। বরং রাজনৈতক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে বেসিক ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ মারাত্দক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। একই সঙ্গে ব্যাংকটি ঋণের সুদ আদায় না করেই আয় হিসাবে দেখিয়ে ব্যাংকের আসল চেহারা আড়াল করেছে। এ নিয়ে ব্যাংকিং মহলে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তবে পরিস্থিতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন শাখায় পরিদর্শন চালায়। পরিদর্শন শেষে ব্যাংকের গুলশান শাখা নিয়ে দেওয়া এক চিঠিতে নজিরবিহীন সব ঋণ বিতরণ, ঋণ প্রস্তাব আসার আগেই বা দ্রুততার সঙ্গে ঋণ অনুমোদন, অস্তিত্বহীন বা ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার একাধিক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এরপর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর জন্য চিঠিও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে একটি চিঠির জবাব দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বেসিক ব্যাংকের এমডিকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়- ‘আপনাদের বক্তব্য বাস্তবতা ও ব্যাংকিং রীতিনীতিবিবর্জিত, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অস্তিত্বহীন কাগুজে-কলমে আছে এমন প্রতিষ্ঠান, বেনামি ও কর্মচারীর নামে তৈরি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া, ঋণ ছাড় করার শর্ত পালন না করা, ঋণ হিসাবের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও নিয়মিত সুদ চার্জ করে তাকে আয় দেখানো, চাতুরীর মাধ্যমে পুনঃ তফসিল ছাড়াই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে খেলাপি না দেখানো এবং বিধিবহিভর্ূতভাবে ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্দসাতের সুযোগ করে দিয়েছে বেসিক ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক একসময় দেশের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। নিয়মনীতি মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ভালো মুনাফা করে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কিছু রদবদল আনার পরই শুরু হয় ব্যাংকটির বিপর্যয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমর্থন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্লিপ্ততায় বেসিক ব্যাংক পরিণত হয় মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠীর লুটপাট আর দুর্নীতির আখড়ায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকসহ দেশের গোটা আর্থিক খাত যখন বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছে, ঠিক তখন বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম-লুটপাটের চিত্র দেখে হতাশ সরকার। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির পর্ষদ ও শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা মিলে গুরুতর অনিয়ম করে, জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় অর্থমন্ত্রীর কাছে বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে জানায়, পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার অধিকাংশই গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকে অনিয়মই হয়ে উঠেছে নিয়ম। সম্প্রতি এ ব্যাংকের অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকৃতদের বিরুদ্ধে ঋণসংক্রান্ত নানা অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।

বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি নেতিবাচক মত দেওয়ার পরও পর্ষদ কোটি কোটি টাকার অনিয়মের ঋণ অনুমোদন করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। ঋণের অর্থ পরিশোধিত হবে না জেনেও ঋণ প্রদান করা হচ্ছে এবং এ ধরনের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে পর্ষদ কর্তৃক আমানতকারীদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৬ ও ৪৭ ধারায় যেসব গুরুতর অভিযোগে কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ ও সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করার বিধান রাখা হয়েছে, এগুলো হলো সে ধরনেরই গুরুতর অনিয়ম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *