নিয়ম আর দুর্নীতিতে কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে শতভাগ রাষ্ট্র পরিচালিত বেসিক ব্যাংক। ভুয়া একাউন্ট দেখিয়ে ব্যাংকটির ৩৫০০ কোটি টাকা পরিকল্পিতভাবে লোপাট করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, ব্যাংকিংয়ের নামে এটা এক ধরনের ডাকাতি। এই ৩৫০০ কোটি টাকা ফিরে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অতি সমপ্রতি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ভেয়ে দেয়ার সুপারিশ করলেও তা এখনও বহাল রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর ক্ষমতার জন্যই পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হচ্ছে না বলে চাউর রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সোনালী ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়েও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল চারদিকে। হল-মার্ককে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়াকে কেন্দ্র করে ওই কেলেঙ্কারি তৈরি হয়েছিল। ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারিও ছিল আলোচিত।
বেসিক ব্যাংক নিয়ে ডাকাতি হচ্ছে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, বেসিক ব্যাংক নিয়ে যা হচ্ছে তা ব্যাংকিং নয়, ব্যাংক ডাকাতি। তিনি বলেন, ব্যাংকটি নিয়ে এত দিন যা হয়েছে তা ব্যাংকিং নামে চালানোর কোন সুযোগ নেই। এটি ব্যাংক ডাকাতি। একই সঙ্গে অনিয়মের জন্য বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্ত করা হলেও চেয়ারম্যানকে কেন ধরা হচ্ছে না সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট নিয়ে গতকাল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সমুন্নয়ে’র এক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক থেকে যে ৪০০০ কোটি টাকা লোপাট হলো, সেটা তো জনগণের টাকা। এই ঘাটতি কোথা থেকে পূরণ করা হবে? আপনি কেন কৈফিয়ত দেবেন না? প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, কালো টাকা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। বৈধ অপ্রদর্শিত আয়ের ক্ষেত্রে এই সুযোগ রাখা যেতে পারে। যেমন জমি বিক্রির ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সময় কম অর্থ দেখানো হয়। সে ক্ষেত্রে বাকি টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। সে জন্য আয়কর আইনে সংশোধন করতে হবে। তবে ঘুষ বা অন্য কোন অবৈধ আয়ের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এ পর্যালোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘সমুন্নয়ে’র প্রকল্প সমন্বয়কারী দিলরুবা ইয়াসমীন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র গবেষক মাহফুজ কবীর।
পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ: এর আগে ঋণ বিতরণ, নিয়োগ বাণিজ্য ও গুরুতর অনিয়মের দায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদও ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২৯শে মে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলম বরাবর পাঠায়। ঘটনার দায় বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারে না উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পাঠানো চিঠিতে সরকারকে বলা হয়, সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৭ ধারায় যে কোন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে রয়েছে। আর ৪৬ ধারায় কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীকে অপসারণের ক্ষমতার কথা বলা আছে। তবে ৪৬ ধারার ৬ উপধারায় সরকার মনোনীত বা নিযুক্ত চেয়ারম্যান বা পরিচালককে অপসারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া হয়নি। তবে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান বা পরিচালকের আচরণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করলে সরকার তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। কিন্তু, ৪৭ ধারায় পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে ৪৬ ধারার ৬ উপ-ধারার মতো করে কিছু বলা হয়নি। সরকারের নিয়োগ দেয়া পরিচালনা পর্ষদই ডুবিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বেসিক ব্যাংককে। শুরু থেকেই পর্ষদের নির্দেশে একের পর এক অনিয়ম করেছে ব্যাংকটি। হাজার হাজার কোটি টাকার গুরুতর ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাধিকবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে এ জন্য সরাসরি দায়ী করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে। নিয়োগ থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে অনিয়মের ফলে ব্যাংকটির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করেছে। অথচ পর্ষদ বা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এর আগে গত ২৬শে মে ব্যাংকটির গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখায় নতুন ঋণ বিতরণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে আগামী দিনে কোন শাখায় ঋণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ব্যাংকটিকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। এর একদিন আগে একাধিক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বিশেষায়িত এ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনিয়মের চিত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের ভিত্তিতে বেসিক ব্যাংকে একটা পরিদর্শন চালায়। সেসময় ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঋণ হিসাব পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের কম্পোজিট ঋণসীমা ১৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সহায়ক জামানত খুবই অপ্রতুল লেনদের অসন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যে গ্রাহকের অনুকূলে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল ঋণ ছাড় করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃপুনঃ মেয়াদ বৃদ্ধির পরও অনাদায়ে মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়েছে (৫০ কোটি টাকা) যার সন্তোষজনক মালামাল মজুত নেই। ইতিমধ্যে মেয়াদি ঋণের কিস্তিও খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক ওয়াহিদুর রহমান। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, একই মালিকের অটো ডিফাইনের ঋণসীমা ১৬৩ কোটি টাকা। এই কোম্পানির ঋণ অনুমোদন করা হয় ২০১০ সালের ২রা নভেম্বর। তার পরদিনই মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। নতুন মালিক হন জনৈকা আসমা খাতুন। এর কারণ হলো দুই কোম্পানির মালিক একই ব্যক্তি হলে তাদের ঋণসীমা একক ব্যক্তি বা গ্রুপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে। ফলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা কৌশলে ওয়াহিদুর রহমানকে এভাবে ঋণ দেন। দুটি ঋণই এখন খেলাপি। পরে আবার গুলশান শাখা থেকেও ওয়াহিদুর রহমানকে ঋণ দেয়া হয়। গুলশান শাখায় মা টেক্স, এসপিএন ও ইএফএস এন্টারপ্রাইজের নামে মঞ্জুর করা ঋণের পরিমাণ ১৭২ কোটি টাকা। কাগুজে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী হচ্ছেন জনৈক শামীম চিশতি।