১০ বছর আগে ৩৫০ কোটি টাকায় সরকারি বেসিক ব্যাংক কেনার জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল একটি বেসরকাির ব্যাংকের সঙ্গে৷ আগ্রহী ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদও এর অনুমোদন দিয়েছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বেসিক ব্যাংক বিক্রি হয়নি৷ সেই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বললেন, এখন উল্টো এক হাজার কোটি টাকা দিলেও বেসিক ব্যাংক তিনি আর কিনবেন না৷
বেসিক ব্যাংকের এই দশা করেছে ব্যাংকটিরই পরিচালনা পর্ষদ৷ ব্যাংকটি এখন লোকসান দিচ্ছে৷ অনিয়ম-দুর্নীতিতে লোপাট হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি৷
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও স্বীকার করেন, বেসিক ব্যাংকের আজকের অবস্থানের জন্য দায়ী পরিচালনা পর্ষদের দুর্বৃত্তপনা৷ বাংলাদেশ ব্যাংকও আইন মেনে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে৷ তার পরও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে েকানো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার৷
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু৷ তাঁর নেতৃত্বেই ব্যাংকটিতে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে৷ তিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ঘনিষ্ঠজন৷ আর এ কারণেই এখনো পদে রয়ে গেছেন তিনি৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর একে ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বলেছেন৷
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে গতকাল আবদুল হাইয়ের অপসারণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও কৌশলে এড়িয়ে গেছেন৷ অর্থমন্ত্রী শুধু এটুকু বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের পর্ষদের দায়িত্ব আমার থাকলেও চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতে পারে।’
অর্থাৎ আর সব সিদ্ধান্তের মতো চেয়ারম্যান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটিও নেবেন প্রধানমন্ত্রী৷ এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই৷
অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কিছু পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে গত ২৫ মে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে। ২৬ মে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২৯ মে বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৪ জুন বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক এস এম অলিউল্লাহকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এদিকে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সমুন্নয়ের এক বাজেট পর্যালোচনা বৈঠকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রািহম খালেদ বেসিক ব্যাংক নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক নিয়ে যা হচ্ছে, তা ব্যাংকিং নামে চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এটি ব্যাংক ডাকাতি। অনিয়মের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে চেয়ারম্যানকে কেন ধরা হচ্ছে না?’
বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কোনো কিছু না থাকায়ও অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেন ইব্রািহম খালেদ। অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক থেকে যে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, সেটা তো জনগণের টাকা। এই ঘাটতি কোথা থেকে পূরণ করা হবে? আপনি কেন কৈফিয়ত দেবেন না।’
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেসিক ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ ছিল দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ২০০৩ সালে নয় হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছর তিন মাসে ব্যাংকটি ছয় হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। যার প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই দেওয়া হয় নিয়ম ভেঙে।
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অনিয়ম তদন্ত শুরু করেও পিছিয়ে যায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পিছিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যখন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করে বেসিক ব্যাংক, তখনই আমরা তদন্ত কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলি। এখন নতুন করে দেখব।’
ব্যাংকটিতে দুর্নীতির হোতা আবদুল হাইয়ের ব্যাপারে সরকারের অন্য দপ্তরগুলোর মতো দুদকও স্নেহসুলভ কি না, জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘না। মোটেই নয়।’ তা হলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন দেখব নতুন করে। কোনো ব্যবস্থা যে নেওয়া হবে না, সে কথা তো বলছি না।’
দুর্নীতির কৌশল: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসলাম আলমের কাছে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে বেসিক ব্যাংকেরই তৎকালীন পরিচালক এ কে এম রেজাউর রহমান একটি চিঠি দেন৷ চিঠিতে লেখা ছিল, আবদুল হাই এমন একটি ধারণা সব জায়গায় তৈরি করে রেখেছেন যে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। ব্যাংকের কার্যালয় ও লবি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা তাঁর ছবিতে ভরপুর। সব সময় এবং সব জায়গায়ই তিনি বলে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ‘কাছের লোক’ তিনি। গোটা বেসিক ব্যাংকে এ রকম একটি আবহ তৈরি করেন আবদুল হাই।
গত বছরের মে মাসে বেসিক ব্যাংকের আরেক পরিচালক এ কে এম কামরুল ইসলামও সচিবকে একই কথা জানিয়ে এসেছিলেন।
জানা গেছে, প্রথাগতভাবে যেকোনো পর্ষদ সভার শুরুতেই আগের সভার কার্যবিবরণী পড়া হয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকে তা হতে দেননি আবদুল হাই। ফলে আগের সভার সিদ্ধান্ত কেউ বুঝতেন না। সভার কার্যসূচি ও প্রচুর কার্যপত্র সভার আগের রাতে দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অল্প সময়ে এগুলো পড়ে যাতে কোনো ভূমিকা রাখা না যায়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের কাছে আবদুল হাইয়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, অন্তত এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চান না তিনি। আবদুল হাইয়ের বক্তব্যও পাওয়া যায়নি৷