রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বাঁচাতে আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসাবে দিচ্ছে সরকার৷ একের পর এক জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারির কারণে চরম মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকগুলো৷ এ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে চার হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে আরও দেওয়া হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সচিবালয়ে গতকাল সোমবার সংযুক্ত আরব আমিরাত-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদান অনুষ্ঠান শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে একের পর এক জালিয়াতি হয়েছে। হল-মার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ জনগণের সম্পদ। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছে সরকার। তাঁদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।
যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান পরিচালক নিয়োগ দিলে এত সহজে জালিয়াতিগুলো হতে পারত না। আর ঘাটতি পূরণে এত টাকাও দিতে হতো না। কিন্তু সরকার বিষয়টিতে মোটেই নজর দেয়নি।’
তবে এসব জালিয়াতির জন্য মূলত তদারক ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক খাতের তদারক সংস্থা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের নিয়োগ দেয় সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও রয়েছে৷
হল-মার্কের জালিয়াতির জন্য পরিচালনা পর্ষদও দায় এড়াতে পারে না বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশসংবলিত চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা পুরোপুরি আমলে নেয়নি। পর্ষদ সদস্যদের দায়মুক্তি দিয়ে দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাওয়ার হোতাও ব্যাংকটির পর্ষদ৷ বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি, বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ এখনই ভেঙে দেওয়া উচিত। আরও আগেই বরং ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।’
অর্থমন্ত্রী অবশ্য জালিয়াতির জন্য একা কাউকে দোষী করতে চান না৷ গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সকলে মিলেই দোষটা মেনে নিতে হবে। কেননা, আমাদের তদারক ব্যবস্থা অতটা শক্তিশালী ছিল না।’
রাষ্ট্রমালিকানাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারকে লভ্যাংশ দেয়, আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের পেছনে উল্টো টাকা ঢালতে হয় সরকারকে, এ রকমটা কেন হচ্ছে—জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর বলেন, ‘আমাদের পরিদর্শন ও তদারক ব্যবস্থায় নানা ধরনের দুর্বলতা ছিল। বড় বড় জালিয়াতি ধরা পড়ায় সেখানে পরিবর্তন এসেছে। হয়তো আরও পরিবর্তন আসবে।’
পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় সদস্য নিয়োগও জালিয়াতি হওয়ার কোনো কারণ কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা বলা যায়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সব সময়ই কিছু না কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকবে। তবে এটা ঠিক, কোনো কোনো সময় আমাদের নির্বাচন (চয়েস) ঠিকমতো হয় না। এতে অসুবিধায় পড়তে হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী—এ চার ব্যাংকের। গত ডিসেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ দেওয়ার পর এ ঘাটতির অনেকটা পূরণ হয়। চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের ঘোষিত চার হাজার ৪০৫ কোটি টাকার মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককেই দেওয়া হয় চার হাজার ১০০ কোটি টাকা।
জালিয়াতির কারণে অর্থ বেরিয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কি না জানতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেকোনো কারণেই ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি থাকতে পারে। তবে জনগণের আমানতের স্বার্থরক্ষা বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে এ ঘাটতি পূরণের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক বলে থাকে। ব্যাংকগুলো তখন মালিক হিসেবে সরকারের দ্বারস্থ হয়। এবারও তাই হয়েছে।