দেশের একটি খ্যাতনামা কোম্পানি ২০০১ সালে বোতলজাত খাওয়ার পানির ব্যবসায় নামে৷ ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়িয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি এখন বোতলজাত খাওয়ার পানির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরবরাহ পর্যায়ে সরকারকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে ব্যান্ডরোল প্রথার মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অর্থ মূসক দেবে, তার ওপর ভিত্তি করে সরকারকে ৩ শতাংশ হারে অগ্রিম কর দিতে হবে।
এভাবেই বোতলজাত পানির উৎপাদকের ওপর করের বোঝা বাড়ল। বাড়ল জটিলতাও৷
পারটেক্স গ্রুপের বোতলজাত পানীয়র ব্যবসা রয়েছে। এই শিল্পগোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার শওকত আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, বোতলজাত পানির উৎপাদকের ওপরে কোনো ধরনের মূসক বা অগ্রিম কর আরোপ করা উচিত নয়৷ কেননা, বোতলজাত পানি বিশুদ্ধ পানির ব্যবসা। এটা জাতির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে।’ প্রস্তাবিত বাজেটে অগ্রিম করারোপের ফলে বোতলজাত পানির উৎপাদকেরা চাপে থাকবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে এই বাড়তি করের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বোতলজাত খাওয়ার পানি উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর যদি ব্যান্ডরোল প্রথায় ১০০ টাকা মূসক দেয়, তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন টাকা অগ্রিম কর দিতে হবে। তবে এই তিন টাকা বছর শেষে ওই কোম্পানি যে আয়কর দেবে, তার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
উল্লেখ্য, ব্যান্ডরোল হলো একধরনের নিরাপত্তা স্ট্যাম্প। এ ধরনের নিরাপত্তা স্ট্যাম্প এনবিআর বিনা মূল্যে উৎপাদককে সরবরাহ করে থাকে। কেননা, এই ব্যান্ডরোল ছাড়া বোতলজাত খাওয়ার পানি বাজারজাত করতে পারেন না উৎপাদকেরা। বোতলজাত খাওয়ার পানির উৎপাদক কী পরিমাণ পণ্য বাজারে ছেড়েছেন, তা ব্যান্ডরোলের হিসাব দিয়ে সহজেই নির্ধারণ করা যায়। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে এখন মূসক আরোপের পাশাপাশি অগ্রিম আয়করও কেটে রাখবে এনবিআর।
বাংলাদেশে পারটেক্স, মেঘনা, সিটিগ্রুপসহ বেশ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী বোতলজাত পানির ব্যবসা করছে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাও বোতলজাত খাওয়ার পানির ব্যবসা করছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগাম করের বোঝাও কৌশলে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন বোতলজাত পানির উৎপাদকেরা৷ কেননা, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে, পণ্য উৎপাদন থেকে সরবরাহের আগ পর্যন্ত তাঁদের কাছ থেকে যত টাকার কর ও শুল্ক নেওয়া হয়, তা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর চাপানো হয়।
তবে অগ্রিম কর কখনোই উৎপাদিত পণ্য, সেবা কিংবা আমদানি করা পণ্যে বাড়তি মূল্য সংযোজন করে না। এটি আসলে উৎপাদক, আমদানিকারক কিংবা সেবা প্রদানকারীর আয়ের ওপর অগ্রিম কর, যা আবার পরে সমন্বয় করা হয়৷ আর তাই এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, এ ধরনের কর ভোক্তার ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে এই করের বোঝা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে থাকেন।
শুধু বোতলজাত খাওয়ার পানির উৎপাদক নন; বেশ কিছু পণ্যের উৎপাদক, আমদানিকারক ও সেবা প্রদানকারীর ওপর উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে কিংবা করের হার বাড়ানো হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। যেমন—মুঠোফোন আমদানিকারক ও অপারেটর, সোনা আমদানিকারক, মুঠোফোন অপারেটর, ট্রাভেল এজেিন্স, অনলাইনে বিজ্ঞাপনদাতাদের উৎসে করের আওতায় আনা হয়েছে। এখন এসব পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মুঠোফোন আমদানি করলে আমদানিকারককে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম করও দিতে হবে। এতে আমদানিকারকের আমদানি খরচ বাড়বে, যা ভোক্তার ওপর পড়তে পারে। এখন আমদানিকারককে শুধু আমদানি শুল্ক দিতে হয়।
সোনা ও রুপা আমদানিকারকের আমদানি খরচও বাড়বে। একজন আমদানিকারক যত টাকার সোনা বা রুপা আনবেন, এর ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর দিতে হবে। তবে এ দেশে ঋণপত্র খুলে সোনা বা রুপা আমদানি করা হয় না। যাত্রীর ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আমদানি করা হয়। ব্যাগেজ রুল পরিবর্তন করে আগামী অর্থবছর থেকে ১৭ ভরির বেশি (২০০ গ্রাম) সোনা আমদানি করলে ভরিপ্রতি তিন হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। সব মিলিয়ে স্থানীয় বাজারে সোনার দাম বাড়তে পারে।
বিভিন্ন ওয়েবপোর্টালে বিজ্ঞাপন দিলে বিল পরিশোধের সময় উৎসে কর হিসেবে ৩ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান তার পণ্যের জন্য একটি ওয়েবপোর্টালে বিজ্ঞাপন দিল। এ জন্য ১০০ টাকার বিল পরিশোধ করার পরিবর্তে ৯৭ টাকা দেবে। বাকি তিন টাকা ওই ওয়েবপোর্টাল মালিকের অগ্রিম কর, যা কেটে রেখে বিজ্ঞাপনদাতা সরকারের কোষাগারে জমা দেবে।
এদিকে মুঠোফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখা হবে। তরঙ্গ বরাদ্দের লাইসেন্স ফি, রেভিনিউ শেয়ারিং ইত্যাদির বিপরীতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে থাকে মুঠোফোন অপারেটররা। এখন সেই অর্থের ১০ শতাংশ করে উৎসে কর কেটে রেখে এনবিআরে জমা দেবে বিটিআরসি। এটা ওই মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম কর, যা বছর শেষে সমন্বয় করা হবে।
এ ছাড়া ট্রাভেল এজেিন্সর প্রাপ্ত কমিশনে ৩ শতাংশ উৎসে কর কাটার বিধান করা হয়েছে।
অবশ্য স্থানীয় ঋণপত্র খুলে যাঁরা পণ্য কেনেন, তাঁদের উৎসে করে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আবার রপ্তানিকারকেরা নগদ সহায়তা পাওয়ার সময় আগের চেয়ে কম উৎসে কর দেবেন।
আগে ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহৃত স্থানীয় ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে ৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎসে কর কেটে রাখা হতো। এনবিআরের প্রস্তাব অনুযায়ী, এখন থেকে পাঁচ লাখ টাকার কম মূল্যের স্থানীয় ঋণপত্র খোলা হলে কোনো উৎসে কর দিতে হবে না। তবে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণপত্র খোলা হলে ৩ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠান যদি স্থানীয় বাজার থেকে ১০ লাখ টাকার পণ্য কেনার জন্য ঋণপত্র খোলে, তবে ওই ঋণপত্রের বিপরীতে বিল পরিশোধের সময় মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক ৩ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রেখে এনবিআরে জমা দেবে।
আবার রপ্তানিকারকেরা রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা পান, সেখানেও উৎসে কর কমানো হয়েছে। এখন থেকে ১০০ টাকা নগদ সহায়তা পেলে ৩ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হবে। আগে এ হার ছিল ৫ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
অগ্রিম আয়কর পরে সমন্বয় করা যায় বলে ভোক্তার ওপর চাপানোর কোনো সুযোগ নেই৷ ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে এই করের বোঝা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে থাকেন
বোতলজাত পানি
বোতলজাত পানিতে মূসকের ওপর ৩ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর কর্তন করা হবে
সোনা-রুপা
একজন আমদানিকারক যত টাকার সোনা বা রুপা আনবেন, এর ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর দিতে হবে
মুঠোফোন
মুঠোফোন আমদানি করলে আমদানিকারককে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম করও দিতে হবে