বাইরে ঠিকঠাক ভেতরটা ফাঁপা

একটি ছোট খবরে চোখ পড়ল। দেশ ছাড়ছেন উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী তরুণেরা। গত পাঁচ বছরে এক হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরেই ত্যাগ করেছেন ২৯৯ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইটি দক্ষতাসম্পন্ন বাংলাদেশিরা দেশ ত্যাগ করছেন। নাগরিকত্ব ত্যাগের হার দিন দিন বাড়ছে। [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ জুন]
একজন মানুষের কাছে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় দু-তিনটি জিনিসের একটি তাঁর জন্মভূমি। অতীতের বাঙালি মনীষীরা বলেছেন: জননী জন্ম ভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। মা ও মাতৃভূমির মর্যাদা স্বর্গের চেয়েও বেশি। সেই জন্মভূমি যখন কেউ চিরদিনের জন্য ছেড়ে যান, তখন তিনি সুখের হাতছানিতেই যে যান তা-ই নয়—গভীরতর দুঃখ ও হতাশা থেকেই যান।
অনেক দিন আগে আমি এক হতভাগিনী মাকে তাঁর এক সন্তান বিক্রি করতে দেখেছিলাম। কিছু টাকার বিনিময়ে—ছেলে খেয়ে-পরে ভালো থাকবে, এই আশায়—এক অবস্থাপন্ন নিঃসন্তানের কাছে তিনি ছেলেকে বিক্রি করেছিলেন। মা সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নৌকায় তুলে দেন। নৌকা কিছু দূর মাঝনদীতে যেতেই মা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন। তাঁকে আমরা সান্ত্বনা দিয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিই। আজ যে প্রায় ষোলো শ মানুষ তাঁদের মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে গেছেন, বাংলা মায়ের যদি ওই দুঃখিনী মায়ের মতো মুখ ও ভাষা থাকত, তাঁদের বিমান আকাশে উড়াল দেওয়ার পরই আর্তনাদ করে উঠত।
ওই প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, বহু বছর ধরে যাঁরা বাংলাদেশে চাকরি করছেন বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং এ দেশেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান, এমন ৩৯ জনকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে গত পাঁচ বছরে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ ও এশিয়ার টাইগার হওয়ার আশায় রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। নাগরিকত্ব ত্যাগ ও প্রদানসংক্রান্ত ফি হিসেবে গত পাঁচ বছরে দুই কোটি ৯৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৫০ টাকা রাজস্ব আয় করেছে। প্রায় ষোলো শ যাওয়াতেই যখন এত আয়, লাখ পঞ্চাশেক বাদে বাংলাদেশ থেকে যদি ১৬ কোটি মানুষ নাগরিকত্ব ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় , তাহলে এই খাত থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যাবে তাতে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র। তখন একটি নয়, ১০টি পদ্মা সেতুও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, নাগরিকত্ব ত্যাগের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যাঁরা গেছেন এবং যাঁরা যাবেন—হতে পারেন তাঁরা স্বার্থপর। তাঁরা তাঁদের নিজেদের এবং তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু যে সাড়ে ১৬ কোটি নাগরিক জন্মভূমি ত্যাগ করেননি এবং করবেন না, তাঁদের উপায় কী? আড়াই লাখ কোটি টাকার মস্তবড় একখানা বাজেট কি একটি দেশের জনগণকে সুখ, শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারে? মাথাপিছু আয় বাড়াই কি 543a972841deca211f5f454609c193bd-09-06-13-ILLUS-MAKSUDএকটি দেশের চরম প্রাপ্তি? গ্রস ডোমেস্টিক হ্যাপিনেসের ওপরে আর কী আছে? গ্রস ডোমেস্টিক হ্যাপিনেসের বিপরীতে হলো গ্রস ডোমেস্টিক আনহ্যাপিনেস—সমষ্টিগত জাতীয় অশান্তি।
যাঁরা দেশ ত্যাগ করেছেন, তাঁরা ভেবে দেখেছেন এ দেশে থাকলে তাঁদের সন্তানদের মেধার কোনো মূল্যায়ন হবে না। যাদের ফেল করার কথা তারাও পাবে জিপিএ–৫; তার সন্তান গোল্ডেন জিপিএ–৫ পাওয়ার উপযুক্ত, সে পাবে কোনোরকমে জিপিএ–৫। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তাঁর ছেলেমেয়ে ৭৭ ভাগ নম্বর পেয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে না। ৪৪ বছর আগের কোনো কৃতীর নাতি-নাতনি অথবা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-কর্মচারীর অমেধাবী পোষ্য ৪২ ভাগ নম্বর পেয়ে বাগিয়ে নেবে একটি ভালো বিষয়। এমন সামাজিক অবস্থায় কেন কেউ দেশ ছাড়বে না? খুব বেশি রকম শারীরিক প্রতিবন্ধী ছাড়া আর যে কারও ক্ষেত্রে কোটার সুবিধা দেওয়া সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।
পরীক্ষায় ভালো করে পাস করলেই যোগ্যতার মূল্যায়ন হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় ক্যাডাররা পাবে অগ্রাধিকার। তাদের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক। ক্ষমতাসীনদের পদলেহনকারী না হলে পদোন্নতির সম্ভাবনা নেই। তার নিচের লোকটি তরতর করে ওপরে উঠে যাবে, তাকে বহন করতে হবে তার ব্যাগ।
অপমানের চেয়ে বড় শাস্তি আর হয় না। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে অপমান করা। কত কর্মকর্তা, কত হেডমাস্টার, অধ্যক্ষ, উপাচার্য যে লাঞ্ছিত হয়েছেন যুবনেতা বা ছাত্রনেতাদের হাতে! ছাত্রের ঘুষিতে কতজন খুইয়েছেন তাঁদের দাঁত। ছাত্রনেতার পদাঘাতে কারও পাঁজরের হাড় চূর্ণ হয়েছে। কত সম্মানিতকে তাঁর অফিসকক্ষে তালা দিয়ে না-খাইয়ে রাখা হয়েছে কত দিন ও কত রাত। তবে এসব অসদাচরণ ও অপরাধ তো নস্যি। শুধু দিনদুপুরে কেউ নিহত হলে সাময়িক বহিষ্কার অথবা অতি অল্প সময়ের জন্য লোক দেখানো গ্রেপ্তার।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুষ, দুর্নীতির দায়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা জেল খাটেন। ইসরায়েল হোক, ইতালি হোক, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া হোক, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদেরও মাফ নেই। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রির তথ্য নিয়ে সামান্য কারচুপিতে এক প্রধানমন্ত্রীর সাজা হয়েছে পূর্ব ইউরোপে কিছুদিন আগে। বাংলাদেশে যে ঘুষ-দুর্নীতি আছে তার কোনো প্রমাণ নেই। সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের চেয়ার-টেবিলের যদি প্রাণ থাকত, তারা বিদ্রোহ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেত চুরির মাত্রা দেখে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ইটে দুর্নীতির চিহ্ন। কিন্তু কতজন মন্ত্রী, সাংসদ, পদস্থ কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান আজ জেল খাটছেন? আজ যদি ৭১ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জেলের ভাত খেতেন, একাত্তরের শহীদদের আত্মা শান্তি পেত। মাঝেমধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *