বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আজ ২২ জুন ২০১৪ বিকেল ৩:৩০ মিনিটে সিরডাপ মিলনায়তনে “ঘোষিত জাতীয় বাজেটে [২০১৪-১৫] প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ ’’ বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাজট্রিজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসিনা নেওয়াজ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়শা খানম।
সভায় সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, নারী আন্দোলনের ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে প্রতি বছর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতীয় বাজেটে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা সভা করে থাকে। কারণ বাংলাদেশ মহিলা মনে করে সমগ্র জাতীয় কল্যাণ না হলে বিচ্ছিন্নভাবে একটি গোষ্ঠীর উন্নয়ন হবে না। সমগ্র বাজেটের প্রেক্ষিতে আমরা আজ জেন্ডার বাজেট নিয়ে নারীর স্বার্থে এবং নারীর জন্য বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করছি। কিন্তু দেখা যায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের বরাদ্দের বিষয়ে বাজেটে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। সমগ্র উন্নয়নে নারীর অদৃশ্যমান যে ভূমিকা তা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে।
মূল প্রবন্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পর্যায়ে উন্নয়ন গতির যে তাগিদ সেই তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দও অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বড়, বলা যাবে না। বাজেট মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব নয়। কোথা থেকে সরকার আয় করে, কোথায় সরকার তা ব্যয় করে তা নির্ভর করে সরকারের উন্নয়ন দর্শনের ওপর, সামাজিক কোন শক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে সরকার তার প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। বাংলাদেশে চোরাই অর্থনীতির বিপুল সম্প্রসারণ হয়েছে গত এক দশকে। যারা এই বিপুল সম্পত্তির মালিক, তারা এখনও কর কাঠামোর বাইরে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই এই চোরাই অর্থনীতি জিডিপির কমপক্ষে ৪২ ভাগ, তা শতকরা ৮৩ ভাগ হতে পারে। শতকরা ৫০ ভাগ ধরলেও এর পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি, বর্তমান বাজেটের দুই গুণের বেশি।বাংলাদেশের বর্তমান পর্যায়ে উন্নয়ন গতির যে তাগিদ সেই তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দও অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বড়, বলা যাবে না। বাজেট মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব নয়। কোথা থেকে সরকার আয় করে, কোথায় সরকার তা ব্যয় করে তা নির্ভর করে সরকারের উন্নয়ন দর্শনের ওপর, সামাজিক কোন শক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে সরকার তার প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। বাংলাদেশে চোরাই অর্থনীতির বিপুল সম্প্রসারণ হয়েছে গত এক দশকে। যারা এই বিপুল সম্পত্তির মালিক, তারা এখনও কর কাঠামোর বাইরে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই এই চোরাই অর্থনীতি জিডিপির কমপক্ষে ৪২ ভাগ, তা শতকরা ৮৩ ভাগ হতে পারে। শতকরা ৫০ ভাগ ধরলেও এর পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি, বর্তমান বাজেটের দুই গুণের বেশি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে বিদেশের অনেক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র সীমার হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ২০১০ হাউসহোল্ড এক্সপেন্ডিচার রিপোর্ট-এ বাংলাদেশে দ্রারিদ্র সীমা হ্রাসের কারণ হিসেবে দুইটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়। একটি হলো গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধি শুরু হয়েছে এবং অন্যটি হলো পরিবারগুলোতে নারীদের নির্ভরতার হার অনেকটা কমে গেছে। বর্তমানে দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে ঘুরছে, ঋন নিচ্ছে, ব্যবসা করছেÑ এটা বাংলাদেশের নারী বিপ্লবের একটি চিত্র। হাউজহোল্ড রিসোর্সে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তারপরও আমরা পিছিয়ে আছি। কারণ বর্তমান বাংলাদেশে গ্যাস, বিদ্যুত, সুশাসন, শিক্ষিত শ্রমিক এবং রাজনৈতিক স্থিরর অভাব। এই পাঁচটি সমস্যা যতদিন না পর্যন্ত আমরা সমাধান করতে না পারবো ততদিন পর্যন্ত আমাদের কোন উন্নয়ন হবে না এবং এর ফলাফল হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হবে নারীরা।
প্যানেল আলোচকবৃন্দ হাসিনা বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসিনা নেওয়াজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাজেটে কতটুকু বরাদ্দ আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমরা যদি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করি, সেখানে দেখা যাবে তার অর্ধেক হচ্ছে নারী। বর্তমানে গামেন্টেস সেক্টরে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে যে দাবি চলে আসছে, তা আগামীতে আরও বেড়ে যাবে। নারীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে খরচ বাড়াতে হবে এবং নারীশিক্ষা ও নারীস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। মানবসম্পদকে উন্নত ও দক্ষ করতে হলে সরকারকে এখানে সর্বোচ্চ ব্যয় করতে হবে। কারণ এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যায় করা হলে তা অবশ্যই দেশের রাজস্ব আয়ে ফিরে আসবে। নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নির্দিষ্টভাবে তাদের আয়কর সীমা বাড়াতে হবে, ঋণ পরিশোধের সময় বাড়াতে হবে এবং নারীউদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় সুযোগ দিতে হবে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চাই এবং যদি টেকসই উন্নয়নের কথা বলি তবে তা বাজেটে তার প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরেই জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের জন্য আন্দোলন করে আসছে। এরই ফলাফল হিসেবে বর্তমানে চল্লিশটি মন্ত্রণালয় জেন্ডার বাজেটের উপর প্রতিবেদন পেশ করেছে। সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যে বাজেট প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন হচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তার স্বচ্ছতা থাকা যেমন প্রয়োজন, মনিটিরিংটাও ততটুকু জরুরি। আমরা মনে করি নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দাবি জানাচ্ছি, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ করা। কিন্তু সেই জায়গাটিতেও আমরা ব্যর্থ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। ঘোষিত জাতীয় বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে এটাই মূল ও শেষ কথা নয়। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের সকলকে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিহ ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি নাহার আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, সহসাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা, প্রশিক্ষণ গবেষনা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক বুলা ওসমান, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনুস।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্দোলন সম্পাদক কাজী সুফিয়া আখ্তার।